আরব বিশ্বের সঙ্গীত জগতে এখন এক দারুণ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বৈরুতের ছোট ক্যাফে থেকে শুরু করে রিয়াদের আধুনিক স্টেজ পর্যন্ত, তরুণ সঙ্গীতশিল্পীদের এক নতুন প্রজন্ম ঐতিহ্যবাহী সুর এবং আধুনিক উদ্ভাবনের এক মুগ্ধকর মিশ্রণ ঘটাচ্ছে। তারা কেবল সঙ্গীতের ঘরানাই নয়, শ্রোতাদের সাথে সংযোগের উপায়ও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন।
সুরের সেতু গড়ছেন জো কামেল : উদের মাধ্যমে শান্তির সন্ধান
লেবাননের বৈরুতে, দিনের বেলায় ফার্মাসিস্ট জো কামেল রাতে পরিণত হন উদের জাদুকরে। একটি ছোট ক্যাফে, ‘ওরেন্ডা’তে তার পরিবেশনাগুলো দ্রুতই স্থানীয়দের পাশাপাশি ইউরোপীয় শ্রোতাদেরও আকর্ষণ করছে।
কামেল বলেন, ‘যখন সবাই গিটার শিখতে চাইত, আমি আরবি ঐতিহ্যের কাছাকাছি কিছু শেখার জন্য উদ বেছে নিয়েছিলাম।’ তার কাছে, ব্যস্ত জীবনের ভারসাম্য রক্ষা এবং মনের শান্তি ফিরিয়ে আনার মাধ্যম হলো এই বাদ্যযন্ত্র।
তিনি লাইভ পারফরম্যান্সকে কেবল শব্দ নয়; বরং ‘শক্তির আদান-প্রদান’ হিসেবে দেখেন। শ্রোতাদের মেজাজ বুঝে তাৎক্ষণিক সেট পরিবর্তন করা তার পরিবেশনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কামেল বিশ্বাস করেন, উদের মতো ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের প্রতি তরুণদের এই আগ্রহ আসলে ডিজিটাল সঙ্গীতের বাইরে ‘সত্যিকারের অনুভূতির’ দিকে ফিরে যাওয়ার একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষার প্রতিফলন।
কায়রোর হিশাম খারমা : পরিচয়কে এগিয়ে নিয়ে চলা
মিসরীয় সুরকার হিশাম খারমা এই নবজাগরণকে ‘স্বাভাবিক বিবর্তন’ হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঐতিহ্য আমাদের পরিচিতি দেয়; কিন্তু নতুনত্ব আমাদের বাঁচিয়ে রাখে এবং বর্তমানের সাথে সংযুক্ত করে।’
খারমা, যিনি পিরামিডের মতো ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে পারফর্ম করেছেন, মনে করেন লাইভ মিউজিক একটি ‘সংলাপ’ যেখানে শিল্পীরা তাৎক্ষণিক আবেগ অনুভব করতে পারেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আরব পরিচিতি হলো অতীতের দিকে তাকানো নয়; বরং সেই সমৃদ্ধ শব্দকে সাহসের সাথে ভবিষ্যতের দিকে ‘বহন করে নিয়ে যাওয়া’। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আঞ্চলিক শিল্পীরা আরো বেশি সাহসী হচ্ছেন, ঘরানার মিশ্রণ ঘটাচ্ছেন এবং আরব সঙ্গীত কী হতে পারে তা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন।’
তামতাম : সৌদি আরবের সৃজনশীলতার নতুন মুখ
সৌদি আরবে, শিল্পী তামতাম এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার গানগুলো আরবি এবং ইংরেজির মধ্যে সহজে আবর্তিত হয়, যা তার দ্বৈত পরিচিতির প্রতিফলন। তার আসন্ন অ্যালবাম, ‘এমএথ্রি আসসালামা’ এই দুই পরিচিতিকেই তুলে ধরে- একদিক আরবি, অন্যদিক পশ্চিমা। তিনি বলেন, ‘আমার পরিচিতিই আমার শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করে।’
তামতাম শুধু নিজের সঙ্গীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন; তিনি ‘গোস্ট ফ্লাওয়ার’ নামে একটি সৃজনশীল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা সঙ্গীতজ্ঞদের একত্রিত করে। এর ‘সৌদি মিউজিক কমিউনিটি’ শিল্পীদের মধ্যে সহযোগিতা এবং একটি শক্তিশালী সমর্থন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করছে। গোস্ট ফ্লাওয়ারের সাম্প্রতিক একটি ইভেন্ট- যা ‘অ্যাপল মিউজিক মেনা’ এর সাথে যৌথভাবে আয়োজিত হয়েছিল তাতেই শিল্পীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টির প্রমাণ মিলেছে।
নবতরঙ্গের মূলমন্ত্র : সংযোগ ও একাত্মতা
বৈরুতের উদের সূক্ষ্ম তার বা রিয়াদের ওয়্যারহাউসের ইলেকট্রনিক বিট, এসব নতুন প্রচেষ্টা একটি সাধারণ উদ্দেশ্য ভাগ করে নেয় : সংযোগ করা, প্রকাশ করা এবং একাত্ম হওয়া।
এই নতুন ধারার আরব সঙ্গীত কেবল শৈলীর পরিবর্তন নয়; এটি মানুষকে তাদের শিকড়, তাদের জাতীয় পরিচিতি এবং একে অপরের সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করছে। জো কামেলের কথায় : ‘আমি চাই আমার সঙ্গীত মানুষের জন্য একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করুক এবং গর্ব, শান্তি ও সঙ্গীত, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে ফিরে যেতে পারবে।’
এই নতুন প্রজন্ম প্রমাণ করছে, আরব সংস্কৃতি কেবল প্রাচীন ইতিহাস নয়- এটি এক গতিশীল, ক্রমবর্ধমান শক্তি যা নিজেদের আধুনিক বিশ্বে জোরালোভাবে প্রকাশ করে চলেছে।



