বিশেষ সংবাদদাতা
কর ফাঁকির কারণে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে দুই লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ রাজস্ব হারিয়েছে করপোরেট কর ফাঁকির কারণে। ২০২৩ সালে আনুমানিক করপোরেট কর ফাঁকির পরিমাণ ছিল প্রায় এক লাখ ১৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
গতকাল সোমবার ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘করপোরেট আয়কর সংস্কার ও কর ন্যায্যতার দৃষ্টিকোন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে তথ্য দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ এবং আলোচনা করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সাল থেকেই কর ফাঁকির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যেমন-২০১২ সালে কর ফাঁকির পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। সেটিই ২০১৫ সালে এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায় পৌঁছায়।
তামিম আহমেদ বলেন, পোশাক, আইসিটিসহ অনেক খাত কর সুবিধা পেয়ে থাকে। দুই লাখ ৮৮ হাজার কোম্পানি রেজিস্টার্ড, কিন্তু ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিশন করেছে মাত্র ৯ শতাংশ কোম্পানি বা ২৪ হাজার ৩৮১ কোম্পানি। এটা একটা বড় বৈষম্য। যারা কর দিচ্ছে তাদের ওপর করের বোঝা বাড়ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চ করহার, জটিল আইন-কানুন, দুর্বল প্রশাসনিক নজরদারি এবং কর ব্যবস্থায় দুর্নীতিই কর ফাঁকির প্রধান কারণ। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৫ শতাংশ কোম্পানি অভিযোগ করেছে, কর প্রদানের সময় তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে এবং ৮২ শতাংশ কোম্পানি করহারকে ‘অন্যায্য’ বলে মন্তব্য করেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত মোট ১২৩টি কোম্পানির ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়। পাশাপাশি তৈরী পোশাক, প্লাস্টিক, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চামড়া খাতের ব্যবসায়ীদের মতামতও নেয়া হয়েছে।
সিপিডি বলছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ বাড়বে যা কর ফাঁকি ও কর পরিহারের ঝুঁকিও বাড়াবে। এ প্রেক্ষিতে সিপিডি কর ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, নীতিগত সংস্কার এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়নের সুপারিশ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগামী দিনে সরকার যদি উচ্চমাত্রায় রাজস্ব না পায় তাহলে ভর্তুকির বৈচিত্রকরণ, দক্ষ জনবল তৈরি করা সরকারের পক্ষে সহজ হবে না। প্রত্যক্ষ কর, অপ্রত্যক্ষ কর ও করবহির্ভূত আয় এই তিন উৎস থেকে মূল রাজস্ব আদায় হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে করপোরেট খাত থেকে। প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব এখান থেকে আসে। আর ভ্যাট থেকে আসে ৪০ শতাংশ রাজস্ব। এই দুই উৎস থেকে প্রায় ৬০ ভাগ রাজস্ব প্রতি বছর আসছে। এ জন্য করপোরেট কর ও ভ্যাটের সংস্কার নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই। তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেট এলে প্রেশারগ্রুপ সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে তার কর হার কমানোর জন্য। এর ফলে কর নিয়ে সরকারের যে লক্ষ্য তা প্রায়ই বিচ্যুত হয়, এটা খোলস আকারে থেকে যায়, যার পরিণতি ভালো হয় না। কর জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর লক্ষ্যে আগামী দিনে একটি কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছি, ২০২৩ সালে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি কর ফাঁকি হয়েছে। এনবিআর অনেক প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করছে। শুধু যে কর ফাঁকি তা নয়, করজালের বাইরেও অনেক খাত ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের করজালের মধ্যে আনা যায়নি। এই বিপুল পরিমাণ ফাঁকি রোধ করতে পারলেও বড় পরিমাণ অর্থ বা রাজস্ব আদায় সম্ভব। তিনি বলেন, ডিজিটালাইজেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ব্যবসায়ী ও এনবিআরের স্বার্থে এটা করা জরুরি। অথচ এ ব্যাপারে এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের এক ধরনের অনীহা রয়েছে। বাংলাদেশে যে কোনো লেনদেন একক ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে, যাতে করে যেকোনো লেনদেন ট্রেস ও ট্র্যাক করা যায়। সেটার আলোকে দাখিলকৃত রিটার্নকে ভেরিভাই করা যায়।
ক্রিশ্চিয়ান এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন বলেন, বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের দেশ প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যখন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করছি প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
সিপিডি বাংলাদেশের ক্রমাগত কর ফাঁকি সমস্যার পেছনে বেশ কয়েকটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চ করের হার, দুর্বল প্রয়োগ, জটিল আইনি কাঠামো এবং কর ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি।
সিপিডি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, কর ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে, উচ্চ মাত্রার কর ফাঁকি সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে এবং যারা আইন অনুসরণ করে তাদের ওপর বোঝা বাড়িয়ে দেয়।