সাক্ষাৎকার : ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান

সংবিধান ফ্যাসিবাদের ম্যানুয়েলে পরিণত হয়েছে

“ফ্যাসিস্ট আমলের যেসব স্ট্যাটেজিক পার্টনার ছিল, ভিন্ন নামে, বিভিন্ন মঞ্চের নামে, বিভিন্ন চেতনার নামে তারা আবার ইনিয়ে বিনিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।”

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান
ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান |সংগৃহীত

বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান বলেছেন, ফ্যাসিস্ট আমলের জাজরা পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে নতুন নতুন সংশোধনী এনে সংবিধানটাকে ফ্যাসিবাদের ম্যানুয়েলে পরিণত করেছেন। এই সংবিধানকে উচিত ছিল শুরুতেই ছুড়ে ফেলা দেয়া। ৫ আগস্টের পর সেটা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, জুলাইয়ের চেতনায়, জুলাই প্রোক্লেমেশন, এই বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যতটা সহজ ছিল, দিন যত যাচ্ছে পলিটিক্যাল ইকুয়েশনগুলো পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর সামনে চলে আসছে। বিভ্রান্তি বাড়ছে। এখন ক্ষমতায় যেতে হলে ডিপস্টেটকে আস্থায় নিতে হবে এই চিন্তাও কেউ কেউ করছে। অনেকে আওয়ামী লীগকে আস্থায় এনে নির্বাচনে দলটির সমর্থক ও ভোটারদের ভোট তাদের বাক্সে নিতে চাচ্ছে। এগুলো জুলাইয়ের চেতনার সাথে গাদ্দারি, বেঈমানি।

ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মনে করেন, বিচারের নামে প্রহসনের অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার জন্যে মৌলিক মানবাধিকার, পররাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রীয় পলিসির ব্যাপারে জাতীয় ঐক্য দরকার। এই ঐক্য যদি ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে না হয় তাহলে পলিটিক্যাল অপনেন্টকে ঘায়েল করার জন্যে আবার একই ধরনের নাটক ভবিষ্যতে যে মঞ্চস্থ হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নাই।

তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, বিভিন্ন সংস্কার কমিশনকে যৌক্তিক পর্যায়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। এটা আমাদের বড় ব্যর্থতা। সামনে নির্বাচন। আমরা ফের গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় ফিরে গেলে মনে হয় না কোনো মিনিংফুল সংস্কার করতে পারব। কারণ ফ্যাসিবাদ চলে গেছে কিন্তু এর শিকড় রয়ে গেছে। ডিপস্টেট রয়ে গেছে। তারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করেছে। ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের যেসব স্ট্যাটেজিক পার্টনার ছিল, ভিন্ন নামে, বিভিন্ন মঞ্চের নামে, বিভিন্ন চেতনার নামে তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে প্রতিটি বিপ্লবের পর একটা প্রতিবিপ্লব হয়। দেশে এখনো অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। ১৬ বছর একটা ফ্যাসিবাদী প্রশাসন ছিল। পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসন বলেন, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফ্যাসিবাদ। এসব প্রতিষ্ঠানে বিপ্লবের পর যে আমূল পরিবর্তন হয়, রিয়েলিটি হচ্ছে তা আমরা এখনো করতে পারিনি। যার কারণে অস্থিতিশীলতা রয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন, নির্বাচন হলে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ হওয়ার কথা। এটাও মনে হয় ফ্যাসিবাদের যে ডিপস্টেট, এরা চাচ্ছে না। যার কারণে গণঅধিকার পরিষদ নেতা নুরুল হক নুরুর উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আবার বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। পরিস্থিতি আসলে নাজুক।

নয়া দিগন্ত : আপনি ডিপস্টেটের কথা বললেন, এ ধরনের কার্যকলাপের পেছনে বাইরের কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রভাব রয়েছে?

নাজিবুর রহমান : দ্যাখেন আমরা তো এখন গ্লোবাল ভিলেজের অংশ। এখানে এক্সটার্নাল ইনফ্লুয়েন্সের বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। আমাদের যেসব উন্নয়ন অংশীদাররা আছে, ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড আছে, আমাদের প্রতিবেশীরা আছে, তাদের সবারই একটা ইনফ্লুয়েন্স আমাদের দেশের ওপর আছে, এটা অনস্বীকার্য।

নয়া দিগন্ত : প্রতিবেশীর কথা বলছেন, ভারতে হাসিনা আশ্রয় নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে তাকে ফেরত চাওয়া হয়েছে, ৫ আগস্টের পর ভারতে বাংলাদেশবিরোধী ব্যাপক অপপ্রচার চলে, তো প্রতিবেশীর সাথে সহাবস্থান কেমন হওয়া উচিত?

নাজিবুর রহমান : প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক হওয়া উচিত সমতার ভিত্তিতে। আমাদের যে স্থায়ী পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি তা হচ্ছে সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়। আমরা কারো দাস না। সম্পর্কটা হবে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে। সমতার ভিত্তিতে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো স্বাধীনতার পর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামল বাদ দিয়ে, বা কিছুটা সময় বাদ দিয়ে অধিকাংশ সময় আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নতজানু ছিল। গত ষোল বছরে এটা ডিজাস্টার পর্যায়ে, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের সম্মিলনে বাংলাদেশে ষোলটা বছর অপশাসন চলেছে। এই আধিপত্যবাদ, তাদের দীর্ঘদিনের যে কায়েমি স্বার্থ নিঃসন্দেহে তাতে বড় একটা আঘাত লেগেছে। কারণ ভারত তার সবগুলো ডিম একটি বাস্কেটে রেখেছে। সেইটা হলো আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের মানুষ যখন তাদের ফ্যাসিবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করল তখন সেটা শুধু আওয়ামী লীগের স্বার্থে আঘাত লাগেনি, তাদের ওপর যারা ইনভেস্ট করেছিল, তাদেরকে যারা ব্যবহার করে আধিপত্যবাদ টিকিয়ে রেখেছিল, তাদেরও স্বার্থে বড় আঘাত লেগেছে। তাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করতে হবে। রাইট ট্রাকে নিয়ে আসা উচিত। এখনো ক্ষেত্র বিশেষে সেই চেতনাবাদী কথাবার্তা কোনো কোনো উপদেষ্টার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে। রাজনীতি সেই একাত্তর, রাজাকার, পাকিস্তান, ভারত এসব কেন্দ্রিক আবর্তিত হচ্ছে।

নয়া দিগন্ত : এ দেশে এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং, যুদ্ধাপরাধের নামে বিচারিক হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না হয় তেমন কোনো মন মানসিকতার পরিবর্তন বা চেষ্টা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন?

নাজিবুর রহমান : দ্যাখেন, আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তিগুলোকে একে একে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য, ধ্বংস করে দেয়ার জন্য তাদের যে পরিকল্পনা ছিল তার অংশ হিসেবেই তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার নামে নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। তারও আগে তারা পিলখানা হত্যাকাণ্ড করেছে, মাঝখানে আপনার শাপলা চত্বর ম্যাসাকার হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধাপরাধের বিচারটা হলো। প্রথম কথা হচ্ছে জনগণ তো এই ফ্যাসিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সাথে ফ্যাসিবাদের যত নাটক ছিল, সকল নাটক, এদের হত্যাকাণ্ড, ম্যাসাকারগুলো ইনক্লুডিং যুদ্ধাপরাধের বিচারও প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু বাংলাদেশের জনগণ নয়, বিশ্বের সব জায়গায় এটাকে মিসক্যারেজ অব জাস্টিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সর্বশেষ আমরা দেখলাম সর্বোচ্চ আদালত যে যুদ্ধাপরাধ বিচারটা হয়েছে তাকে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করে বললেন এটা বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। আমরা দুঃখিত যে আমাদের আদালতকে ব্যবহার করে এটা হয়েছে। এখন বিচারের নামে প্রহসনের অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার জন্যে মৌলিক মানবাধিকার, পররাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রীয় পলিসির ব্যাপারে জাতীয় ঐক্য দরকার। এই ঐক্য যদি ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে না হয় তাহলে পলিটিক্যাল অপনেন্টকে ঘায়েল করার জন্যে আবার একই ধরনের নাটক ভবিষ্যতে যে মঞ্চস্থ হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নাই।

নয়া দিগন্ত : ওই অপশক্তি তো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, যুদ্ধাপরাধের রায় নিয়ে সর্বশেষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিল।

নাজিবুর রহমান : হ্যাঁ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই পারে। বিপ্লবের পর আমাদের কিছু ভালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাতীয় ঐক্যমত কমিশন, বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে কিন্তু আমরা যেটা দেখলাম এর কোনোটিকেই আমরা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারিনি। এটা আমাদের বড় ব্যর্থতা। সামনে নির্বাচন। আমরা ফের গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় ফিরে গেলে মনে হয় না কোনো মিনিংফুল সংস্কার করতে পারব। কারণ ফ্যাসিবাদ চলে গেছে কিন্তু এর শিকড় রয়ে গেছে। ডিপস্টেট রয়ে গেছে। তাদের যারা সুবিধাভোগী ছিল তার একটা বিপুল অংশ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে, বাকিরা রয়ে গেছে। এরা যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আদালতের সর্বশেষ রায় মানতে পারবেন এবং পার্শ্ববর্তী দেশের ইঙ্গিতে তারা মাঠে নামবে এটাই স্বাভাবিক। বিপ্লব পরবর্তী স্বল্পতম সময়ে তারা মাঠে নামবে এটা সারপ্রাইজিং। গণতান্ত্রিক দেশে সবার কথা বলার অধিকার আছে। তাদের যদি জেনুইন ডিফেন্স থাকে তো তারা প্রতিবাদ করবে কিন্তু যেভাবে তারা বিষয়টিকে পুঁজি করে শাহবাগের মতো একটা মব সৃষ্টি করেছিল একই কায়দায়, একই স্লোগানে তাদের মাঠে নামতে দেয়াটা দুর্ভাগ্যজনক।

নয়া দিগন্ত : জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত একটা প্রতিরোধ ছিল। ওই ধরনের প্রতিরোধের অভাব রয়েছে কি?

নাজিবুর রহমান : জার্মানিতে নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে একটা ঐকমত্য হয়েছিল যার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এতদিন পরও সেখানে নাৎসিবাদ ফিরে আসতে পারেনি। এবং নাৎসিবাদের প্রচার বা কোনো কিছু প্রমোট করা অপরাধ। বাংলাদেশে যে ফ্যাসিবাদ নির্বিচারে নিজের জনগণের ওপর গুলি চালালো তাকে আমরা হটালাম, অল্প কয়েক দিন পরই দেশে বিদেশে তারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করেছে। ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের যেসব স্ট্যাটেজিক পার্টনার ছিল, ভিন্ন নামে, বিভিন্ন মঞ্চের নামে, বিভিন্ন চেতনার নামে তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একটা সভ্যদেশে এটা হতে পারে না। যে দেশে অপআদর্শকে পুঁজি করে একটা শক্তি জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াল, পাইকারি হারে হত্যা করল, তাদের আবার সেই চেতনাকে পুঁজি করে মাঠে নামতে দেয়া, এটা তো হতে পারে না।

নয়া দিগন্ত : আমরা তো এখনো জুলাই সনদ করতে পারিনি।

নাজিবুর রহমান : জুলাই সনদ করার যে সময় ছিল তা আমরা মিস করেছি। ৫ আগস্টের পর এক মাসের মধ্যে জুলাই সনদ করে ফেলা উচিত ছিল। ফ্যাসিবাদের যে মূল সূতিকাগার বা যেটাকে তারা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার ম্যানুয়েল বানিয়ে ফেলেছে সেই ৭২’এর সংবিধান যার আদৌ কোনো লেজিটেমেসি আছে কি না এইটা প্রশ্নবিদ্ধ। সেই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলা উচিত ছিল। ৭২’এর সংবিধান জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে হয়নি। ৭১এ একটা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আমরা এ দেশকে পেলাম। কুষ্টিয়ার মুজিবনগরের আম্রকাননে মুক্তিযুদ্ধকালীন যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল তার একটা প্রোক্লেমেশন ছিল। সেই প্রোক্লেমেশনে সেক্যুলারিজম ছিল না, সমাজতন্ত্র ছিল না। এটাকে কোনো রকম গণভোট ছাড়া কিভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো আজ পর্যন্ত তার কোনো ব্যাখ্যা কেউ দেননি। সংবিধান প্রণয়নের আগে কোনো গণপরিষদ গঠন করা হয়নি। সত্তরে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক হলো, যেটার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করে। তাদের ক্ষমতায় যেয়ে নতুন সংবিধান করার কথা ছিল। একটা মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত অধ্যায়ের মাধ্যমে আমরা নতুন একটা দেশ পেলাম। সত্তর সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ওয়াদা করেছিল দুটি বিষয়ে। এক, তারা কুরআন সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করবে না। পাকিস্তান ভাঙবেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ পরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিল। সংবিধানের খসড়া নিয়ে একটা গণভোট দেয়া যেত কিন্তু আওয়ামী লীগ তা করেনি।

নয়া দিগন্ত : সাংবিধানিক ইস্যু নিয়ে অসমাপ্ত কাজগুলো কি সমাপ্ত করা উচিত নয়?

নাজিবুর রহমান : অবশ্যই। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান নিয়ে জনগণের যে অভিপ্রায় তার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এই ফ্যাসিস্ট আমলের জাজেরা, খায়রুল হক সহ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে নতুন নতুন সংশোধনী এনে সংবিধানটাকে ফ্যাসিবাদের ম্যানুয়েলে পরিণত করেছেন। এই সংবিধানকে উচিত ছিল শুরুতেই ছুড়ে ফেলা দেয়া। ৫ আগস্টের পর সেটা দেয়া হলো না। সংবিধানের অধীনে প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে অভিমত নিয়ে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলো। এ ধরনের সরকারের কোনো প্রভিশন সংবিধানে রাখা হয়নি। এখানেই আমাদের বড় ভুলগুলো হয়ে গেছে। সেই সময় জুলাইয়ের চেতনায়, জুলাই প্রোক্লেমেশন, এই বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যতটা সহজ ছিল, দিন যত যাচ্ছে পলিটিক্যাল ইকুয়েশনগুলো পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর সামনে চলে আসছে। বিভ্রান্তি বাড়ছে। ক্ষমতায় যেতে হলে ডিপস্টেটকে আস্থায় নিতে হবে এই চিন্তা কেউ কেউ করছে। অনেকে মনে করছে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু তাদের একটা পার্সেন্টেজ অব ভোট তো রয়েছে। তাদেরকে আস্থায় এনে তাদের ভোট আমাদের বাক্সে নিতে হবে এই ধরনের চিন্তা কেউ কেউ করছে। এগুলো জুলাইয়ের চেতনার সাথে গাদ্দারি। বেঈমানি।

নয়া দিগন্ত : রিকনসিলিয়েশনের কথা বলছেন অনেকে।

নাজিবুর রহমান : গ্রহণযোগ্য ফয়সালার অনেক পথ আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করার পর যারা এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন তারা ফ্রি অ্যান্ড ফ্রাঙ্ক তা স্বীকার করেছেন। যাদের সাথে এ ধরনের অপরাধ করা হয়েছে তারা মাফ করে দিয়েছেন। একটা ন্যাশনাল হারমনি বা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে যেতে হলে অপরাধীদের অপরাধ সম্পর্কে অনুশোচনা থাকতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি এতগুলো মানুষকে হত্যার পর কোনো অনুশোচনা নেই, হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করছে না। উল্টো তারা হত্যাকাণ্ডের জন্যে বিপ্লবী ও সাধারণ মানুষকে দায়ী করছে।

নয়া দিগন্ত : তরুণদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?

নাজিবুর রহমান : গত ষোল বছর রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু ফ্যাসিবাদ পতনে কম চেষ্টা করে নাই। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদকে সমূলে উৎপাটন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এরপর একটা গণবিস্ফোরণ হয়েছে, এখানে সবার অংশগ্রহণ ছিল। ন্যাচারালি বিএনপি বড় দল, তাদের সবচেয়ে বেশি নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ ছিল। দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীরও বিশাল একটা পার্টিসিপেশন ছিল। কিন্তু নেতৃত্ব কারা দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে তো তরুণেরা। এই তরুণরাই এ দেশকে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত করেছে। শুধু এইবার না, বিশ্বের যত বিপ্লব হয়েছে যত আন্দোলন হয়েছে, এর মূল নিয়ামক শক্তি ছাত্র কিংবা শ্রমিকরা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মূলত ছাত্ররাই প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। তরুণ সমাজের বড় ধরনের ত্যাগকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। যে তরুণরা রক্ত দিয়েছেন তাদের যারা সহপাঠী ছিলেন, সহকর্মী ছিলেন, অন্য কেউ তার সঙ্গে বিট্রে করলে করতে পারে, কিন্তু তাদের পক্ষে তো বিট্রে কোনোভাবেই করা সম্ভব না। এই আন্দোলনের মূল বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী একটা দেশগড়ার আগ পর্যন্ত তরুণ সমাজের কোনোভাবেই বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ নাই।