আওয়ামী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে বৃহত্তম লবণ শিল্প জোন

রাজস্ব আদায় বন্ধ

প্রায় ৭০টি লবণ কারখানা অধ্যুষিত শিল্প অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী লীগপন্থী পরিবহন মালিকদের একটি গ্রুপ। এতে বৈধ ইজারাদাররা সঠিকভাবে লবণ রফতানি শুল্ক আদায় করতে পারছেন না, আর সরকার হারাচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব।

আতিকুর রহমান মানিক, ঈদগাঁও (কক্সবাজার)
Printed Edition

কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের লবণ শিল্প জোনটি দেশের বৃহত্তম পরিশোধিত লবণ উৎপাদনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখানে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের গঠনকৃত সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে সরকারি রাজস্ব আদায়। প্রায় ৭০টি লবণ কারখানা অধ্যুষিত শিল্প অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী লীগপন্থী পরিবহন মালিকদের একটি গ্রুপ। এতে বৈধ ইজারাদাররা সঠিকভাবে লবণ রফতানি শুল্ক আদায় করতে পারছেন না, আর সরকার হারাচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব।

অভিযোগ রয়েছে, লবণবাহী প্রতিটি ট্রাক থেকে গায়ের জোরে তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করছে এই সিন্ডিকেট। অথচ ইউনিয়ন পরিষদের প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে লবণ রফতানি শুল্ক সংগ্রহের দায়িত্ব নেয়া ইজারাদার নূরল আমিন ও মনির আহমেদরা সাত মাস ধরে বৈধভাবে টোল সংগ্রহ করতে পারছেন না।

ইজারাদারদের ভাষ্যে, অপসারিত জেলা পরিষদের সদস্য ও পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা আরিফ, উপজেলা আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক শরিফ, নেতা নূরুল আলম ওরফে ভাইয়া আলম, আবু বক্কর, নজরুল, নাছির উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট সংগঠিতভাবে রাজস্ব আদায়ে বাধা দিচ্ছে। বিষয়টি থানার ওসি, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে লিখিতভাবে জানানোর পরও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।

ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন জানান, ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বৈধভাবে ইজারা দিয়ে এই শুল্ক আদায় চলে আসছে। স্থানীয় সরকার আইনের ধারা অনুযায়ী সব সদস্যের সম্মতিতে চলতি বছরের ১ মে বৈধভাবে ইজারা দেয়া হয়। তার দাবি, অতীতে ট্রান্সপোর্ট ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের যোগসাজশে নামমাত্র টাকায় ইজারা নিয়ে কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এবার ইজারার টাকা নিয়মমাফিক ইউনিয়ন পরিষদের হিসাব শাখায় জমা করায় সিন্ডিকেট ক্ষুব্ধ হয়ে রাজস্ব আদায়ে বাধা দিচ্ছে।

শিল্পাঞ্চলের কারখানা মালিকদের ভাষ্যে, দেশের মোট পরিশোধিত ও ভোজ্য লবণ চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ আসে ইসলামপুর থেকে। সেখানে বৈধ টোল আদায় বন্ধ থাকায় গত সাত মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বেসরকারি সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইজারাদার যেমন, তেমনি রাষ্ট্রও।

ইজারাদাররা জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সব পক্ষ নিয়ে মিটিং করে বৈধ টোল আদায়ে নির্দেশ দিলেও সিন্ডিকেট নির্দেশনা মানছে না। অভিযুক্ত নূরুল আলম, শরিফ ও আরিফ ফোন রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অভিযুক্তদের একজন আবু বক্কর বলেন, ‘আমরা ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা করি; ইজারাদাররা এলে টোল দেবোই।’

ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ বলেন, ইজারাভিত্তিক শুল্ক সংগ্রহ একটি প্রতিষ্ঠিত নিয়ম। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি বিষয়টিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি আশঙ্কা করেন, টোল বিরোধের সমাধান না হলে শিল্পাঞ্চল থেকে দেশের বিভিন্ন মোকামে লবণ সরবরাহ ব্যাহত হয়ে বাজারে সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুস সাকিব খান জানান, ঈদগাঁও থানার ওসিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান বলেন, তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার অধিদফতরের উপ-পরিচালককে দেয়া হয়েছে।

ইসলামপুরের লবণ শিল্প শুধু একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই নয়; এটি দেশের খাদ্যশিল্প, রফতানি ও স্থানীয় শ্রমবাজারের ওপরও সরাসরি প্রভাব ফেলে। সেই শিল্প যদি রাজনৈতিক শক্তির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে, তবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব, শিল্পোন্নয়ন এবং দেশের লবণ বাজারের স্থিতিশীলতা, সব কিছুই।