- সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন
- মাত্র ০.৫২ শতাংশ স্কুলের ওপর সমীক্ষা
বিধান থাকলেও যথাযথভাবে সমীক্ষা করে দেশে উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে না। দায়সারা সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা করেই প্রকল্পের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়নের মতো প্রকল্পটিরও সমীক্ষা হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ স্কুলের ওপর। যেখানে বলা আছে ৩০ শতাংশের ওপর সমীক্ষা করে প্রকল্প নিতে হবে। ৬৫ হাজার ৫৬৬টি স্কুলের মধ্যে সমীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৩৪৩টি বা ০.৫২ শতাংশের ওপর। সেই সমীক্ষা দিয়েই ১৪ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া এতে বিদেশে প্রশিক্ষণে দেড় কোটি টাকা এবং পরামর্শক খাতে ৬১ কোটি টাকার খরচ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে খোদ পরিকল্পনা কমিশন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশাধিকারের উন্নতির পরও শিক্ষার মান এখনো উদ্বেগের বিষয়। কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অনুপস্থিতি, উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাব এবং জরাজীর্ণ ছয় শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার্থীদের শেখার অভিজ্ঞতাকে ব্যাহত করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। মেয়েদের তালিকাভুক্তি এবং উপস্থিতি উন্নতি হলেও বাল্যবিয়ে ও সামাজিক রাখার মতো চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রায় অর্ধেক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার বিদ্যালয়ের ভবন জরাজীর্ণ। এসব বিদ্যালয়ে রয়েছে অপর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, বিদ্যুৎসুবিধার অভাব, সুপেয় পানির অভাব এবং টয়লেট সমস্যার গুরুতর চ্যালেঞ্জ। এমন বাস্তবতায়, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ এবং বিদ্যালয়ে নিরাপদ ও শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা মানোন্নয়ন ও ঝরে পড়ার হার কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এ জন্য ৩ হাজার ৪৭৬টি স্কুলের শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, টাইলস বসানো, আসবাবপত্র সরবারাহ করাসহ উন্নয়ন কাজের জন্য ১৪ হাজার ৩৫০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী তিন বছরের প্রকল্প হওয়ার কথা থাকলেও মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ বছরের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, কর্মঘণ্টা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সিঙ্গেল শিফটের মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করা। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ উন্নত এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, বিদ্যমান জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নতুনভাবে নির্মাণের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত শিখন-শেখানোর পরিবেশ নিশ্চিত করা। উন্নত অবকাঠামো ও সুবিধাগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে শিশুর শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা। প্রত্যন্ত ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে সমতা নিশ্চিত করা।
প্রকল্পের আওতায় মূল কাজগুলো হলো, দেশের ২৪ হাজার ৭৪২টি বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ বা শিক্ষক কক্ষ (টাইলসসহ) নির্মাণ, তিন লাখ ৮৩ হাজার ১৮০টি নির্মিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ বা প্রি-প্রাইমারি কক্ষ বা প্রধান শিক্ষক কক্ষ বা শিক্ষক কমনরুমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসবাবপত্র সরবরাহ এবং তিন হাজার ৪৭৬টি মাস্টার প্ল্যান, সাব-সয়েল ইনভেস্টিগেশন ও ডিজিটাল টগো সার্ভে প্রণয়ন করা।
খরচের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, টাইপ-এ ভবনে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণে প্রতি বর্গফুট তিন হাজার ২১৯.০২ টাকা ধরে মোট ৪৭ লাখ ২২ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। টাইপ-বি ভবনে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণে প্রতি বর্গফুট তিন হাজার ৩৯৮.৫৬ টাকা ধরে মোট ৫৫ লাখ টাকা, টাইপ-সি ভবনে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণে প্রতি বর্গফুট তিন হাজার ৮২.০৯ টাকা ধরে মোট ৫৬ লাখ ১১ হাজার টাকা, টাইপ-ডি ভবনে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণে প্রতি বর্গফুট তিন হাজার ১৯২.০৬ টাকা ধরে মোট ৬৬ লাখ ১১ হাজার টাকা, টাইপ-ই ভবনে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণে প্রতি বর্গফুট দুই হাজার ৩৯৭.৭১ টাকা ধরে মোট ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ এই ব্যয়কে অত্যধিক মনে করছে। এ ব্যয় যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা প্রয়োজন বলে তারা পরামর্শ দিয়েছে।
দেখা যায়, কোড-৩২৫৭১০১ পরামর্শক বাবদ ৬০ কোটি ৪০ লাখ ৪৮ হাজার টাকা (এলজিইডি, পিডব্লিউডি ও ইইডি) বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ব্যয় প্রস্তাব অত্যধিক মনে করছে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। এ ছাড়া পরামর্শকের সংখ্যা, কার্যপরিধি, প্রয়োজনীয়তা পুনর্গঠিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্তি করা প্রয়োজন। আর কাস্টমাইজ প্রজেক্ট মনিটরিং সফটওয়্যার বাবদ ২ কোটি ৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এটাও অত্যধিক বলছে পরিকল্পনা কমিশন। নির্মাণধর্মী প্রকল্পে এ সফটওয়্যায়ের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তার পর্যালোচনা করা দরকার বলে তাদের পরামর্শ।
জানা গেছে, ফিজিব্যালিটি স্ট্যাডিতে যে সকল স্কুলে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে সে সব স্কুল ভবনে (টাইপ-বি, ডি) দুইটি সিঁড়ি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রস্তাবনার দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, (টাইপ-বি, ডি) দু’টি সিঁড়ির প্রস্তাব করা হয়নি। কিন্তু দুইটি সিঁড়িসহ ড্রয়িং/ডিজাইন ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একই স্কুল বিল্ডিংয়ে দুইটি সিঁড়ির পরিবর্তে প্রয়োজনে প্রশস্ত করে একটি সিঁড়ি নির্মাণ করা যৌক্তিক বলে পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শ। এতে পূর্ত কাজের ব্যয় আসবে। দুইটি সিঁড়ি ধরে (টাইপ-বি, ডি) যদি পূর্ত কাজের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়ে থাকে তা বাদ দেয়া প্রয়োজন বলে পরিকল্পনা কমিশন বলছে।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের পর্যালোচনা হলো, এই সমীক্ষা অপ্রতুল। নমুনা চয়নের ভিত্তিতে করা হলেও তার মান হলো ৩০ শতাংশ। কিন্তু এখানে সেটা করা হয়নি। উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর করার নিয়ম। কিন্তু এই প্রকল্পে পাঁচ বছরের প্রস্তাব করা হয়েছে। সূত্র মতে, বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে প্রস্তাবনাটিকে আবার আলোচনা সংশোধন করে পাঠানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন কমিটির সভা থেকে বলা হয়েছে।



