প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত ইসরাইল-হামাস

Printed Edition
গাজার বাসিন্দারা রাস্তায় নেমেছেন এই আশায় যে, ইসরাইলের যুদ্ধ শেষ হচ্ছে : আলজাজিরা
গাজার বাসিন্দারা রাস্তায় নেমেছেন এই আশায় যে, ইসরাইলের যুদ্ধ শেষ হচ্ছে : আলজাজিরা

নয়া দিগন্ত ডেস্ক

দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের পর অবশেষে ইসরাইল ও হামাস ‘প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চুক্তি’তে সম্মত হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এক সামাজিক মাধ্যম পোস্টে বলেন, ‘ইসরাইল ও হামাস গাজার যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।’

আলজাজিরা জানায়, ওয়াশিংটনের স্থানীয সময় বুধবার নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক বার্তায় ট্রাম্প এই ঘোষণা দেন। ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি খুবই গর্বের সাথে ঘোষণা করছি যে ইসরাইল ও হামাস উভয়েই আমাদের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বাক্ষর করেছে। খুব শিগগিরই সব বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে এবং সমঝোতার ভিত্তিতে ইসরাইলও গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে।’

ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের অন্যতম মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারও যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করা এক বার্তায় বলেছেন, ‘আমরা (এ যুদ্ধের) মধ্যস্থতাকারীরা এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, আজ রাতে গাজায় শান্তি স্থাপন সংক্রান্ত নতুন পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের সব শর্ত ও বিধান বাস্তবায়নে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, এই চুক্তি স্বাক্ষরের জেরে গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটবে, সব ইসরাইলি বন্দী ও ফিলিস্তিনি কারাবন্দীরা মুক্তি পাবে এবং গাজায় ত্রাণসামগ্রী প্রবেশে আর কোনো বাধা থাকবে না। তবে চুক্তির বিস্তারিত বিষয়গুলো পরবর্তীতে ঘোষণা করা হবে।

চুক্তির ধাপগুলো

ইসরাইলি সরকারের মুখপাত্র শোশ বেডরোসিয়ান জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।

তিনি বলেন- ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি বন্দিবিনিময় শুরু হবে। হামাসের নেতা মারওয়ান বারঘুতিকে এই ধাপে মুক্তি দেয়া হবে না। বন্দিবিনিময় শেষে ইসরাইলি সেনারা ‘ইয়েলো লাইন’ পর্যন্ত সরে যাবে এবং তারা গাজা ভূখণ্ডের প্রায় ৫৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে রাখবে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর সোমবার ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন ও দফতর হোয়াইট হাউজে গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত নতুন একটি পরিকল্পনার ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। সে সময় তার পাশে ছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সেদিন ট্রাম্প বলেছিলেন, তার পরিকল্পনার কপি ইসরাইল, হামাস এবং অপর দুই মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসর ও কাতারকে পাঠানো হয়েছে এবং হামাস ব্যতীত বাকি সবাই তাতে সম্মতি দিয়েছে।

পরে ৩ অক্টোবর শুক্রবার হামাস সম্মতি জানানোর পরদিন ৪ অক্টোবর ইসরাইলকে গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে বলেন ট্রাম্প। এরপর ৬ অক্টোবর মিসরের শারম আল শেখ-এ ট্রাম্পের প্রস্তাবের ওপর ইসরাইল, হামাস, মিসর, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। সেই বৈঠকে দুই দিনেরও বেশি সময় ধরে আলোচনার পর ট্রাম্পের চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিতে ইসরাইল-হামাস স্বাক্ষর করল। এই চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক ঘণ্টা আগে হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ের সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, আলোচনা খুবই ভালো দিকে এগোচ্ছে এবং তিনি ‘এ সপ্তাহের শেষের দিকে, সম্ভবত রোববার, মধ্যপ্রাচ্যে যেতে পারেন।’

চুক্তিতে কী আছে?

ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের স্থায়িত্ব হবে ছয় সপ্তাহ। এই ছয় সপ্তাহে নিজেদের হাতে থাকা সব বন্দীকে মুক্তি দেবে হামাস। এর বিনিময়ে ইসরাইল গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ, ইসরাইলের কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তি এবং গাজা থেকে পর্যায়ক্রমে সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। একজন হামাস কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই চুক্তির আওতায় তাদের হাতে আটক থাকা ২০ জন জীবিত ইসরাইলি পণবন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে। বিনিময়ে দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে। এর মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত, বাকি এক হাজার ৭০০ জনকে যুদ্ধ শুরুর পর আটক করা হয়। চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এই বিনিময় সম্পন্ন হবে। একটি ফিলিস্তিনি সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, এটি অন্য ফিলিস্তিনি দলগুলোর সাথে সমন্বয় করে চূড়ান্ত হয়েছে।

সূত্রটি আরো জানায়, চুক্তিতে বন্দিবিনিময়ের সাথে সমন্বয় করে ‘নির্দিষ্ট স্থান থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার’ এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত গাজা উপত্যকায় ‘ত্রাণ প্রবেশের’ বিষয়টি রাখা হয়েছে। হামাস জানায়, যুদ্ধবিরতির প্রথম পাঁচ দিনে প্রতিদিন অন্তত ৪০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করবে। পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা বাড়বে। এ ছাড়াও গাজার দক্ষিণ থেকে বাস্তুচ্যুতদের গাজা সিটি ও উত্তরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। হামাস ট্রাম্পকে আহ্বান জানিয়েছে, তিনি যেন চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে ইসরাইলকে বাধ্য করেন এবং তারা যেন এড়িয়ে যাওয়ার বা বিলম্ব করার সুযোগ না পায়।

ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার বড় ঝুঁকি কী কী?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চির প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়াও ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে; রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, গাজায় রক্তপাত বন্ধের জন্য ট্রাম্পের প্রস্তাব ‘সেরা’ এবং এ মুহূর্তে এই প্রস্তাবের কোনো বিকল্প নেই।

রয়টার্স জানায়, তবে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের প্রস্তাবে এখন কয়েকটি বড় ঝুঁকি রয়ে গেছে। যেমন প্রথমত, ট্রাম্পের প্রস্তাবে হামাসকে সম্পূর্ণ অস্ত্র সমর্পণ করতে বলা হয়েছে; কিন্তু হামাস এই প্রস্তাবে এখনো সায় দেয়নি। যুদ্ধের গত দুই বছরে এর আগেও হামাসকে কয়েকবার অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই তারা সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। একই অবস্থা গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও। ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর বেশ কয়েকবার ইসরাইলকে গাজা উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে; কিন্তু বরাবরই তাতে আপত্তি জানিয়েছে ইসরাইল। গত ৩ অক্টোবর হামাস নতুন প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় সম্মতি জানানোর পরদিন ৪ অক্টোবর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে টেলিফোন করে গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে বলেন ট্রাম্প। নেতানিয়াহু তাতে সম্মতিও জানান।

তবে ট্রাম্প আহ্বান জানানোর পর গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর বোমাবর্ষণ কমলেও সম্পূর্ণ থামেনি। ট্রাম্প গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধের আহ্বান জানানো পর গত চার দিনে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযানে গজায় নিহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। এমনকি ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে মিসরে যখন হামাস, ইসরাইল, মিসর, কাতার ও ইসরাইলের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক চলছিল, তখনো গাজায় বোমাবর্ষণ করেছে ইসরাইলের বাহিনী। গাজার সিভিল ডিফেন্স বিভাগ জানিয়েছে, বুধবার রাতে উত্তর গাজায় বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। আরো একটি বড় জটিলতা আছে। ইসরাইলি বাহিনীর গত দুই বছরের অভিযানে বিশ্বজুড়ে শক্তিশালী হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের দাবি। গত ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে মধ্যপ্রাচ্যের আল আকসা অঞ্চলে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়ন এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের দাবিতে বৈশ্বিক সম্মেলন হয়েছে। এই সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিল ফ্রান্স ও সৌদি আরব। জাতিসঙ্ঘের অধিকাংশ রাষ্ট্র এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সেটি বয়কট করেছিল।

সেই সম্মেলনে এবং সম্মেলনের আগে ও পরে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয় ফ্রান্স, বেলজিয়াম, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, লুক্সেমবার্গসহ বেশ কয়েকটি দেশ। এ যুদ্ধের দুই মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার, মিসর এবং পুরো আরব ও মুসলিমবিশ্ব স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে সোচ্চার। তবে নেতানিয়াহু ও তার নেতৃত্বাধীন সরকার তীব্রভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধী। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাতেও এ বিষয়টিকে কম গুরুত্ব দিয়ে গাজার ওপর ফোকাস করা হয়েছে।

ইসরাইল ও গাজাবাসীর আনন্দ-উৎসব উদযাপন : রাতের আকাশে আনন্দের গুলির আওয়াজ, আর কান্না মেশানো উল্লাসে ভরে ওঠে গাজা ও ইসরাইলের বিভিন্ন প্রান্তে যখন বৃহস্পতিবার শান্তিচুক্তির খবর পৌঁছে যায় বিধ্বস্ত গাজায় এবং সেইসব ইসরাইলি পরিবারে, যারা গত দুই বছর ধরে যুদ্ধের শুরু থেকে হামাসের হাতে বন্দী প্রিয়জনদের ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। দ্য গার্ডিয়ান জানায়, ‘আজ বিশাল একটা দিন, অশেষ আনন্দের,’ গাজার শহর থেকে ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আহমদ শেহেইবার। ‘আমি খবরটা বিশ্বাসই করতে পারছি না,’ বলেন খান ইউনুসের বাসিন্দা আয়মান সাবের। উপকূলীয় এলাকা আল-মাওয়াসিতে লোকজন একত্রিত হয়ে স্লোগান দেন ‘আল্লাহু আকবর’ এবং আনন্দে আকাশে গুলি ছোড়েন। তবে সবকিছুর মধ্যেও রয়েছে বড় আশঙ্কা। কারণ ইসরাইল চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ট্রাম্প প্রস্তাবিত ২১ দফা শান্তি পরিকল্পনা বৃহস্পতিবার ‘প্রাথমিক ধাপে’ বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে ইসরাইল ও হামাস- এই খবর আসতেই ইসরাইলের রাস্তায় শুরু হয় আনন্দোৎসব।

দুই বছর ধরে বন্দী প্রিয়জনদের ফেরার জন্য আন্দোলনরত পরিবারগুলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন, কেউ কেউ চোখের পানি ফেলেন, কেউ শ্যাম্পেন খুলে উদযাপন করেন। ‘মাতান বাড়ি ফিরছে। এ সেই অশ্রু, যার জন্য আমি প্রার্থনা করেছি,’ বলেন এক ইসরাইলি মা, যার ছেলেকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস গাজায় নিয়ে গিয়েছিল। তেল আবিবের ‘হোস্টেজ স্কোয়ারে’ কিছু মানুষ ট্রাম্পকে শান্তিচুক্তিতে ভূমিকার জন্য ‘নোবেল পুরস্কার’ দেয়ার দাবি তোলেন। একজন সাবেক বন্দী, ব্রিটিশ-ইসরাইলি এমিলি দামারি, ইনস্টাগ্রামে নিজের বন্ধু ও সাবেক বন্দী রোমি গোনেনসহ একটি ভিডিও পোস্ট করেন, যেখানে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন, নাচছেন এবং ‘ল’খাইম (অর্থাৎ ‘জীবনের জন্য’) বলে পানীয় তুলছেন।

মধ্য গাজার বাস্তুচ্যুত ত্রাণকর্মী আইয়াদ আমাউই বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করছি আবার অবিশ্বাসও করছি আনন্দ আর বেদনার মিশ্র অনুভূতি। আশা করি এই চুক্তি বাস্তবায়িত হবে, মানুষ ঘরে ফিরতে পারবে এবং জীবনের প্রতি নতুন করে আশা জাগবে।’ তবে তার সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ইসরাইল চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ‘এখানে আমাদের সব কিছু নতুন করে গড়তে হবে, বিশেষ করে মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে জীবনে ফিরে যেতে হবে।’ যদিও আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে, তবুও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চুক্তির বিস্তারিত স্পষ্ট নয় বিশেষ করে ভবিষ্যতে গাজার শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, অথবা ট্রাম্পের দাবিমতো হামাস কি নিরস্ত্র হবে কি না, তা এখনো অজানা। যদি এই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি গত দুই বছরে যুদ্ধ বন্ধের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হবে যে সঙ্ঘাত এরই মধ্যে ইরান, ইয়েমেন ও লেবাননের মতো দেশগুলোকে জড়িয়ে আঞ্চলিক রূপ নিয়েছে এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি বদলে দিয়েছে।

হামাসকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে : ইসরাইলি দূত

হামাসকে ইসরাইলি বন্দীদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গাজা থেকে জীবিত ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে বলে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ইয়েহিয়েল লেইটার। যদি এই সময়সূচি নিশ্চিত হয়, তবে গাজায় আটক জীবিত ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি রোববার বা সোমবারের মধ্যেই সম্পন্ন হতে পারে।

সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত লেইটার সতর্ক করে বলেছেন, ইসরাইল এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ীভাবে সঙ্ঘাতের অবসান ঘটাবে বলে আশা করছে। তবে এটি নির্ভর করবে হামাস চুক্তির শর্তগুলো কতটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে তার ওপর। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি এই যুদ্ধবিরতি সম্পূর্ণভাবে শত্রুতা বন্ধ করবে ও গাজার জনগণের কল্যাণে ও ইসরাইলের স্বার্থে গাজা পুনর্গঠনের পথ খুলে দেবে।’ লেইটার যোগ করেন, এ চুক্তিটি প্রথম ধাপ মাত্র। পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যেই ইসরাইলকে দেখতে হবে যে এই প্রথম ধাপটি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না।

বন্দী উদ্ধারের পর হামাসকে ধ্বংস করার হুমকি ইসরাইলের অর্থমন্ত্রীর : ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য এবং উদ্যোগ গ্রহণের জন্য পরিচিত ইসরাইলি কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ বলেছেন, গাজা থেকে বন্দীরা দেশে ফেরার পর হামাসকে ধ্বংস করতে হবে। তার এ বক্তব্যের কারণে সদ্য চুক্তিতে পরিণত হওয়া প্রথম ধাপের হামাস-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ শঙ্কার মুখে পড়েছে। আলজাজিরা জানায়, বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে এই মন্তব্য করেন স্মোত্রিচ। স্মোত্রিচ লেখেন, বন্দীরা যখন দেশে ফিরবে, তখনই ইসরাইল সব শক্তি নিয়ে হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ ও নির্মূলের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, যাতে তারা আর ইসরাইলের জন্য হুমকি না হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আরো বলেন, তিনি গাজা যুদ্ধ শেষ করতে হামাসের সাথে হওয়া কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তির পক্ষে ভোট দেবেন না। তবে তিনি নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে সমর্থন প্রত্যাহারের বা সরকার পতনের হুমকি দেননি।

ধ্বংস হওয়া গাজা পুনর্গঠনে লাগবে ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি : দখলদার ইসরাইলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছে ৬৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন আরো দুই লাখ। ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদসহ প্রায় সব অবকাঠামো।

জাতিসঙ্ঘের হিসাবে গাজার ৮০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। পুনর্গঠনে লাগবে অন্তত ৫২ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ছয় লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তা জোর্গে মোরেইরা দা সিলভা জানিয়েছেন, যুদ্ধ শেষ হলে প্রথমে ধ্বংসস্তূপ সরানোকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

শান্তিরক্ষী পাঠাতে প্রস্তুত ইতালি : চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রয়োজন হলে দেশটি গাজায় সেনা পাঠাতে প্রস্তুত। শুক্রবার সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট এক্স-এ অ্যান্তোনিও তাজানি বলেন, ‘শান্তি নিকটে’। তিনি আরো বলেন, ‘ইতালি সর্বদা মার্কিন পরিকল্পনাকে সমর্থন করে আসছে। যুদ্ধবিরতি সুসংহত করতে, নতুন মানবিক সহায়তা প্রদান করতে এবং গাজার পুনর্গঠনে অংশ নিতে ইতালি ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত। ফিলিস্তিনকে আবার একত্রিত করার জন্য যদি একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী তৈরি করা হয়, তবে আমরা সেনা পাঠাতেও প্রস্তুত।’

ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজায় না ফিরতে সতর্কবার্তা : এ দিকে ইসরাইল গাজার ফিলিস্তিনিদের সতর্ক করে বলেছে, তারা যেন গাজা উপত্যকার উত্তর অংশে ফিরে না যায়। গাজার উত্তরের এলাকা এখনো একটি বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র। এক্সে প্রকাশিত এক পোস্টে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আভিখাই আদরিয়ি বলেন, ‘আইডিএফ (ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) এখনো গাজা সিটিকে ঘিরে রেখেছে, যেখানে ফিরে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।’ তিনি আরো বলেন, ‘নিজেদের নিরাপত্তার জন্য গাজার উত্তরাঞ্চলে ফিরে যাবেন না বা এমন এলাকায় যাবেন না, যেখানে আইডিএফ বাহিনী অবস্থান করছে বা অভিযান চালাচ্ছে। সেটা গাজা উপত্যকার দক্ষিণ ও পূর্ব অংশসহ যেকোনো স্থানে। শুধু সরকারি নির্দেশনা জারি হওয়ার পরই সেখানে যাওয়া নিরাপদ হবে।

গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসরাইল : গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য প্রয়োজনীয় অপারেশনাল প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী আইডিএফ। প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা দেয়ার পরই আইডিএফের তরফ থেকে এ ঘোষণা এসেছে। আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলের সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছে যে, তারা হামাসের সাথে বন্দী-যুদ্ধবিরতি সমঝোতা চুক্তির অংশ হিসেবে গাজা উপত্যকা থেকে আংশিকভাবে সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতি শুরু করেছে। আইডিএফ টেলিগ্রামে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং পরিস্থিতি মূল্যায়নের ভিত্তিতে আইডিএফ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অপারেশনাল প্রস্তুতি শুরু করেছে।’ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী বলেছে তারা ‘নিকট ভবিষ্যতে সামঞ্জস্যকৃত মোতায়েন লাইনগুলোতে সেনা স্থানান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ‘আইডিএফ এখনো ওই এলাকায় মোতায়েন রয়েছে এবং যেকোনো অপারেশনাল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত।’

যা বলছেন বিশ্ব নেতারা : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমি গর্বিত যে ইসরাইল ও হামাস উভয়েই আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সই করেছে। এটি আরব ও মুসলিম বিশ্ব, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। তিনি আরো বলেন, গাজা পুনর্নির্মিত হবে, মানুষ একে অপরের সাথে মিলেমিশে চলবে- একটি নতুন বিশ্ব শুরু হবে।

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, আজ ইসরাইলের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। আগামীকাল আমি সরকারকে আহ্বান করব চুক্তি অনুমোদনের জন্য এবং আমাদের জিম্মিদের ঘরে ফেরাতে। হামাস এক বিবৃতিতে কাতার, মিসর, তুরস্ক ও ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ জানায় এবং ইসরাইলকে চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়।

বিবৃতিতে বলা হয় আমাদের জনগণের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না; আমরা স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, এটি দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি কাতার, মিসর, তুরস্ক ও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং গাজা ও পশ্চিমতীরের সংযোগ পুনঃস্থাপনের ওপর জোর দেন। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, যুদ্ধের অবসান, বন্দিবিনিময় ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের বিষয়ে সব দফা ও বাস্তবায়ন কাঠামোতে চুক্তি হয়েছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছেন। আমরা চুক্তি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবো এবং ১৯৬৭ সালের সীমারেখায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাবো।

সৌদি আরব আশা প্রকাশ করেছে যে চুক্তিটি গাজাবাসীর মানবিক কষ্ট লাঘবে এবং ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহারে সহায়ক হবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মাসের পর মাস দুর্ভোগের পর এই চুক্তি একটুখানি আশার আলো। তিনি সব পক্ষকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে আহ্বান জানান। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, মস্কো চুক্তির প্রথম ধাপকে সমর্থন করছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারীদের প্রশংসা জানাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেন, এটি আশার এক আলো—আট দশকের সহিংসতা ও সন্ত্রাসের পর এখনই সময় এই চক্র ভাঙার। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, আমি যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তি চুক্তি স্বাগত জানাই। এখন জরুরি হলো মানবিক সহায়তা ও নিরবচ্ছিন্নভাবে গাজায় প্রবেশ নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, এই চুক্তি যেন দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথে স্থায়ী শান্তির সূচনা হয়।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, এই চুক্তি যুদ্ধের সমাপ্তি এবং রাজনৈতিক সমাধানের সূচনা ঘটাবে। ফ্রান্স এ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, চুক্তির বাস্তবায়ন বিলম্ব ছাড়াই সম্পূর্ণভাবে হতে হবে এবং গাজায় মানবিক সহায়তার ওপর সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ গৃহীত হওয়ায় আমরা স্বাগত জানাই। এটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

দোহা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তামার কারমাউত বলেন, ‘হামাসকে রাজনীতি থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়, কারণ এটি একটি ধারণা। টেকসই শান্তির জন্য হামাসকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের জন্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা এখন অপরিহার্য।’

উপসংহার

দুই বছরের যুদ্ধ, লাখো বাস্তুচ্যুতি ও অভাবনীয় মানবিক সঙ্কটের পর গাজায় শান্তির সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। তবে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার, বন্দিবিনিময় ও মানবিক সহায়তার বাস্তবায়নই নির্ধারণ করবে- এই যুদ্ধবিরতি সত্যিই শান্তির সূচনা কিনা, নাকি কেবল এক অস্থায়ী বিরতি।

হামাস জানিয়েছে, এবার তারা ইসরাইল বন্দীদের হস্তান্তরের সময় কোনো প্রচারধর্মী অনুষ্ঠান করবে না। সংগঠনটির এক মুখপাত্র আলজাজিরাকে বলেন, ‘পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে জীবিত ও মৃতদের একসাথে হস্তান্তর করা হতে পারে।’

তবে ইসরাইলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি এখনো কার্যকর হয়নি। এরই মধ্যে দক্ষিণ গাজায় তিনজন হামাস সদস্য সেনা শিবিরে হামলার চেষ্টা করলে গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে।

দীর্ঘ দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের পর এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন পর্বের সূচনা করতে পারে। তবে হামাসের পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ, গাজার পুনর্গঠন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।