কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আকস্মিক পদ্মার আগ্রাসী থাবায় জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধের প্রায় ১৫০ মিটার অংশ বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মার ২ ঘণ্টার এই ভয়াবহ ভাঙনে বাঁধের পাশে থাকা ১২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও একটি টিন শেড বাড়ির আটটি কক্ষ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এ সময় অনেক চেষ্টা করেও শ্রমিক সঙ্কট ও বৈরী আবহাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর রক্ষা করতে পারেনি। চোখের সামনেই বিলীন হয়ে যায় সবকিছু। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে পদ্মার তীরবর্তী আলমখার কান্দি, হাজী ওসিমুদ্দিন মাদবর কান্দি ও স্থানীয় মঙ্গল মাঝির বাজার।
অন্যদিকে আষাঢ়ের শেষার্ধের ভারী বর্ষণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। অতিবর্ষণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে রাঙামাটিতে। ইতোমধ্যে ২৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। লক্ষ্মীপুরে মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। নোয়াখালী ও পটুয়াখালী শহরের অনেক জায়গা ডুবে গেছে।
শরীয়তপুর থেকে মো: বোরহান উদ্দিন রব্বানী জানান, তাৎক্ষণিক ভাঙন রোধে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করেছে। গতকাল সকালে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মো: ওয়াহিদ হোসেন, পুলিশ সুপার মো: নজরুল ইসলাম ও জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাবেরী রায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এছাড়াও শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার এ কে এম নাসির উদ্দিন কালু জাজিরা উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের খোঁজখবর নেন।
স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে ২০১০-১১ অর্থবছরে পদ্মা সেতু থেকে মাঝির ঘাট হয়ে পূর্ব নাওডোবা আলমখার কান্দি জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই কিলোমিটার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এর পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই এলাকায় পদ্মার ভাঙন দেখা যায়নি। গত নভেম্বর মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের এই বাঁধটির প্রায় ১০০ মিটার নদীতে ধসে যায়। পরে ধসে যাওয়া বাঁধটির সংস্কারে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দেয়া হলে ওই স্থানে বালুভর্তি জিওব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলার কাজ শুরু করা হয়। দ্বিতীয় দফায় চলতি বছরের ৮ জুন সকালে একই স্থানে প্রায় ১৫০ মিটার অংশ নদীতে ধসে পড়ে। পরে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে নতুন করে জিওব্যাগ ডাম্পিং করে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরপর সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নতুন করে রক্ষা বাঁধের মঙ্গলমাঝির ঘাটসংলগ্ন এলাকায় হঠাৎ করে আবারো ভাঙন শুরু হয়। স্থানীয়রা কোনো কিছু বুঝার আগেই ২ ঘণ্টার এই ভয়াবহ ভাঙনে প্রায় ১৫০ মিটার রক্ষা বাঁধ, পদ্মাতীরসংলগ্ন স্বপন মাদবরের একতলা আট কক্ষের একটি পাকা ঘর, রাজা মাদবরের একটি ঘর, শুকুর খালাসির হার্ডওয়্যারের দোকান, ফরিদ মাদবরের সারের দোকান, ফিরোজ মাঝির মেশিনারিজ দোকান, সাত্তার খার কাঁঠালের গোডাউন, সালাম পোদ্দারের চায়ের দোকান, শুকুরের চায়ের দোকান, নোয়াব আলী শেখের মুদি মালের গোডাউন, মিন্টুর সেলুন, স্বপনের সেলুনসহ ১২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙন আতঙ্কে নদীতীরবর্তী আরো অন্তত ২০টি বসতঘর ও ১০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ ব্যাপারে মঙ্গল মাঝি বাজারের ব্যবসায়ী সিরাজ শেখ ও আবু আলেম শেখ ও মজিবুর হাওলাদার জানান, বিকেলে বাজারের অনেক ব্যবসায়ী দুপুরের খাবার ক্ষেতে গেছে, আবার অনেকে বাজারেই অবস্থান করছে। এর মধ্যে হঠাৎ দেখি লোকজন ছোটাছুটি করছে। দোকান বন্ধ না করেই দৌড়ে গিয়ে দেখতে পাই একের পর এক ঘর নদীতে পড়ে যাচ্ছে। আমরা অনেক চেষ্টা করি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতঘরগুলোর মালামাল সরানোর। কিছু কিছু ঘরের মালামাল সরাতে পারলেও চোখের সামনেই অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালামালসহ পুরো ঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
স্থানীয় চেয়ারম্যান মো: আলতাফ খান বলেন, পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে এই ভাঙন দেখা দিয়েছে। একে একে এই বাঁধে তিনবার ভাঙনের সম্মুখীন হওয়ায় এই এলাকার নদীতীরবর্তী গ্রামের মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে অচিরেই হারিয়ে যাবে নাওডোবা এলাকার পদ্মা তীরবর্তী দু’টি গ্রাম ও মঙ্গলমাঝির হাট। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি পদ্মা পারের এই এলাকার মানুষের জন্য দ্রুত স্থায়ী তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে ভাঙনের কবল থেকে আমাদের রক্ষা করা হোক।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান বলেন, এই বাঁধটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। বাঁধটিতে আরো দুইবার ধস হওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে দু’টি প্যাকেজে ৫৯ লোখ টাকা ব্যয়ে জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। গত সোমবার পুনরায় বাঁধটির আরো একটি অংশ ধসে যাওয়ায় গতকাল সকাল থেকেই ভাঙন রোধে জিওব্যাগ ফেলা শুরু করেছি। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাবেরী রায় বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাঙনকবলিত ক্ষতিগ্রস্ত ১২ পরিবারের মধ্যে নগদ পাঁচ হাজার করে টাকা ও ১৬ পরিবারকে ছয় হাজার করে টাকার চেক প্রদান করেছি।
ফেনীতে মুহুরী-কহুয়া বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫ স্থানে ভাঙন
ফেনী অফিস জানিয়েছে, ফেনীতে দুই দিনের অতি ভারী বৃষ্টি ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাঁচটি স্থান ভেঙে গেছে। এতে জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দিনভর টানা বর্ষণে ফেনী শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নিচু এলাকার দোকানপাট, বাসা-বাড়িতেও ঢুকছে পানি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যাপরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বননিয়ন্ত্রণ বাঁধের জঙ্গলঘোনায় দু’টি স্থান, গদানগর, দেড়পাড়া, সাহেবনগরসহ পাঁচটি স্থানে ভাঙন হয়েছে।
জেলা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মজিবুর রহমান জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী এ সময় ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী দুইদিন হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এ দিকে অতি ভারী বৃষ্টিতে শহরের বেশির ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়ক, শান্তি কোম্পানি সড়ক, পাঠানবাড়ি সড়ক, একাডেমি, মাস্টারপাড়া, সহদেবপুর, পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টার, মিজানপাড়া, বিরিঞ্চি, বারাহিপুর এলাকায় দুই থেকে চার ফুট পর্যন্ত পানিতে ভাসছে।
পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক গোলাম মোহাম্মদ বাতেন জানান, বর্ষা মৌসুমের আগ থেকেই পৌরসভার ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। একইভাবে খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবুও হঠাৎ অতিভারী বৃষ্টির কারণে ধীরগতিতে পানি নামছে। পৌরসভার ছয়টি টিম রাত থেকে কাজ করছে বলে তিনি জানান। বৃষ্টিপাত কমলে পানি দ্রুত নেমে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আকতার হোসেন মজুমদার জানান, ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫টি স্থান ভেঙে গেছে। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অপরদিকে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তিনি পুলিশ সুপারসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নিয়ে ফুলগাজী-পরশুরামের এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢলে ভেঙে গেছে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ
ছাগলনাইয়া-পরশুরাম (ফেনী) সংবাদদাতা জানিয়েছেন, ভারতের ত্রিপুরার উজানে দুই দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট বন্যার পানির তোড়ে ফেনীর সীমান্তবর্তী মুহুরী নদী ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে গতকাল সকাল থেকে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার বিস্তৃর্ণ জনপদ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকাল রাত পৌনে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভারতের ত্রিপুরার বিলোনার দিক থেকে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদী হয়ে উজানের পানির তোড়ে পরশুরামের উত্তর শালধর,ধনিকুন্ডাসহ অন্তত পাঁচটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে প্রশাসন। রাতে মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১৭৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধিও ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের জংগলঘোনায় দু’টি, গদানগরে, দেড় পাড়া, সাহেব নগরসহ পাঁচটি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে বলে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। ভারতের সিলোনিয়ায় মুহুরী নদীর ওপর নির্মিত বনকরে বনকর সেতু থেকে ভারতে সাংবাদিকদের সূত্রে জানা গেছে প্রবল বেড়ে হু হু করে মুহুরী নদী হয়ে বাংলাদেশে বন্যার পানি প্রবেশ করছে।
পানিতে ডুবে গেছে নোয়াখালী শহর
নোয়াখালী অফিস জানায়, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে মুষলধারে বৃষ্টিতে নোয়াখালী শহর পানিতে ডুবে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে নোয়াখালী আবহাওয়া বিভাগ। সোম ও মঙ্গলবার টানা ভারী বর্ষণে জেলা শহর মাইজদীর প্রেস ক্লাব সড়ক, টাউন হল মোড়, ইসলামিয়া সড়ক, ডিসি সড়ক, মহিলা কলেজ সড়ক, জেল খানা সড়ক, মাইজদী বাজার সড়ক, ইসলামিয়া সড়ক, বিভিন্ন বাড়িঘর, মাইজদী আল ফারুক অ্যাকাডেমিসহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে চলাচলে চরম দুর্ভোগে পড়েন শহরবাসী।
স্থানীয়রা জানান, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব এবং পানি নিষ্কাশনের নালা ও জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় শহরবাসীর এ দুর্ভোগ। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন অনেকে। হালকা বৃষ্টিতেই নোয়াখালী পৌরসভা এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া নোয়াখালীর ৯টি উপজেলার নিচু এলাকা পানিতে ডুবে গেছে।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, বিভিন্ন এলাকা আমি ঘুরে দেখেছি। প্রধান সড়কগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। তবে পাশের কিছু সড়ক পানিতে ডুবে গেছে।
পটুয়াখালী শহর পানিতে ভাসছে
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, সোমবার টানা ভারী বর্ষণে পটুয়াখালী শহরের অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সোমবার থেকে একটানা বৃষ্টির ফলে মঙ্গলবার সকাল থেকে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ও আশপাশের এলাকা হাঁটুসমান পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়াও ঢুকেছে জোয়াড়ের পানি। পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিস জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে । শহরের নতুন বাজার, সদর রোড, চরপাড়া, জুবিলী সড়ক, মহিলা কলেজ, কালেক্টরেট স্কুল, কলেজ রোড, এসডিও রোড, পোস্ট অফিস সড়ক, সবুজবাগ, তিতাস সিনেমা হল সংলগ্ন এলাকা ও পুরানবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে বসতবাড়ি ও দোকানপাটে। অপরদিকে অতিভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার দরুন শ্রেণী কক্ষে জলবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় শেরেবাংলা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গতকালের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে।
জলাবদ্ধতার কারণে শহরের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট করে পৌঁছাতে দেখা গেছে। অফিসগামী মানুষকেও পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে। রাস্তাঘাটে যান চলাচল প্রায় বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে রিকশাচালক ও দিনমজুরদের রোজগারে বড় প্রভাব পড়েছে।
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে অর্ধশতাধিক গ্রামে বন্যা
কক্সবাজার অফিস জানায়, সপ্তাহব্যাপী টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে জেলার উখিয়া ও টেকনাফের অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের বেশকিছু বাড়িঘর বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া অফিস।
ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার অন্তত ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে জেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে উখিয়া উপজেলার ১০ গ্রাম এবং টেকনাফ উপজেলার ৪০ গ্রাম প্লাবিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া উখিয়ার তিনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও জলাবদ্ধতার তথ্য মিলেছে।
টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য মতে, টেকনাফে ভারী বৃষ্টিপাতে অন্তত কম হলেও ৮০ হাজার মানুষ বন্দী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে হোয়াইক্যং ইউনিয়নে আটটি গ্রাম, হ্নীলা ইউনিয়নে সাতটি গ্রাম, টেকনাফ পৌরসভার পাঁচটি গ্রাম, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রাম, সাবরাং ইউনিয়নে সাতটি গ্রাম, বাহারছড়া ইউনিয়নে আটটি গ্রাম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহেসান উদ্দিন বলেন , ‘ভারী বর্ষণের ফলে কিছু গ্রামে মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে। তাই সকাল থেকে ঝুঁঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে।
অপর দিকে উখিয়ায় টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ১০টি গ্রামে জলাবদ্ধতাসহ সবজিতে, বীজতলা ও পানের বরজ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি গ্রামীণ রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে বলেন, এলাকায় দ্রুত পানি নিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নামের তালিকা তৈরি করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদেরকে বলা হয়েছে।
অব্যাহত বর্ষণে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনের কলাতলী প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে সড়কে যান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হওয়ায় কক্সবাজার ভ্রমণে আসা পর্যটকরা দুর্ভোগে পড়েছেন।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আসা পর্যটকদের সতর্কতার সাথে গোসল করতে বলছে লাইফগার্ড কর্মীরা। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে টেকনাফের সাথে সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের মধ্যে নৌযোগাযোগ এখনো বন্ধ রয়েছে।
চকরিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, সমুদ্রের নিম্নচাপের প্রভাবে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় গত দুই দিন ধরে ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। টানা বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে মাতামুহুরি নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারী বর্ষণে অব্যাহত থাকায় চকরিয়া পৌর এলাকায় দেখা দিয়েছে জলবদ্ধতা। পানিবন্দী হায়ে পড়ছে কয়েক হাজার পরিবার । ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বা পাহাড়ের পাদদেশে ও বেড়িবাঁধসহ নদীর পাড়ের জনসাধারকে নিরাপদে আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য উপজেলা ও পৌর প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। সোমবার রাত থেকে এ মাইকিং করা হচ্ছে ।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেন এবং এলাকায় বসবাসরত লোকজনকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে এবং পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়ার আহ্বান জানান। উপজেলায় এখনো থেমে থেমে ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের শঙ্কা
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে রাঙ্গামাটিতে গত তিনদিন ধরে অব্যাহত প্রবল বর্ষণে পাহাড়ি জনপদে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ ও শঙ্কা। টানা বৃষ্টির ফলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা বাড়ায় জেলা প্রশাসন জরুরি সতর্কতা জারি করেছে, পাশাপাশি খোলা হয়েছে ২৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র। প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে। বৃষ্টি চলাকালে যেন কেউ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান না করে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে অবস্থান নেয়।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত প্রায় ২০ হাজার মানুষ সরাসরি পাহাড় ধসের ঝুঁঁকিতে রয়েছেন। তাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে প্রতিটি উপজেলায় মাঠে সর্তক রয়েছে উপজেলা প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবক দল ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। রাঙ্গামাটি জেলা সদরে ২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার ১০টি উপজেলায় অস্থায়ীভাবে আরো ২৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং কমিউনিটি সেন্টারগুলো আশ্রয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ (মারুফ) বলেন, আমরা ঝুঁঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করেছি এবং ইতোমধ্যে সেখানে মাইকিং করে সতর্ক বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। আমাদের অগ্রাধিকার হলো, কোনোভাবে যেন মানুষের প্রাণহানি না ঘটে।
এ দিকে থেমে থেমে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলেও রাঙ্গামাটি আবহাওয়া অফিস থেকে নির্দিষ্ট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ জানা যায়নি। ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
জেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সূত্রে জানা গেছে, শুধু রাঙ্গামাটি শহরে ৩১টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে অতীতে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। রাঙ্গামাটিতে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এবার আগেভাগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন। ২০১৭ সালে পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ, যার মধ্যে সেনা সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন।
মির্জাগঞ্জের জনজীবন বিপর্যস্ত
মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে একটানা বৃষ্টিপাতে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের জনজীবন স্থাবীর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষাও স্থাগিত করা হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে নিম্নাঞ্চল, গ্রামীণ রাস্তাঘাট, ফসলের ক্ষেত ও মাছ চাষের পুকুর। কখনো ভারী আবার কখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার পূর্ব সুবিদখালী গ্রামের হিন্দু পাড়াটিসহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে অনেক এলাকায়। এতে অনেক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বৃষ্টিতে বিদ্যুতের লাইনে গাছ পড়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে।
লক্ষ্মীপুরে মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টি
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, লক্ষ্মীপুরে গতকাল সকাল থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৬১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা এই মৌসুমে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃষ্টির রেকর্ড। বিষয়টি জানিয়েছেন রামগতি আবহাওয়া সতর্কীকরণ অফিসের কর্মকর্তা মো: সৌরভ হোসেন। এই কর্মকর্তা বলেন, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ, সক্রিয় মৌসুমি বায়ু ও পূর্ণিমার প্রভাবের কারণে বৃষ্টি হচ্ছে। এটি আরো কয়েক দিন চলবে।
দুই দিন টানা বৃষ্টির কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, অফিসগামী মানুষ ও দিনমজুর শ্রেণীর মানুষ। বিশেষ করে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে মারাত্মক সমস্যার মুখে পড়েছেন। অনেকেই পলিথিনে বই মুড়িয়ে, জুতা হাতে নিয়ে পানি পার হয়েছেন। শহরের বেশিরভাগ রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে যাত্রীদের দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হয়েছে।
টানা বৃষ্টির কারণে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। বিশেষ করে শহরের জেবি রোড, কলেজ রোড, বাঞ্ছানগর, মজুপুর ও শমসেরাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে পানি জমে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে পৌরবাসী।
পৌরবাসীর অভিযোগ, অপরিকল্পিতভাবে ড্রেনেজ নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলে শহরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে প্রতিনিয়ত চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। দ্রুত ড্রেনেজ পরিষ্কার করে পানি সরানো না হলে আরো দুর্ভোগ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বৃষ্টি এইভাবে অব্যাহত থাকলে বন্যার শঙ্কাও করছেন অনেকে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক ও লক্ষ্মীপুর পৌরসভার প্রশাসক মো: জসীম উদ্দিন বলেন, যেসব জায়গায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে পৌরসভার পক্ষ থেকে পানি সরানোর কাজ করা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে ৭ কি.মি. জুড়ে যমুনার ভাঙন
বাসস জানায়, যমুনার তীব্র স্রোতে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার স্থল ইউনিয়নের প্রায় সাত কিলোমিটারজুড়ে ব্যাপক ভাঙন চলছে। ভাঙনে বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গতকাল দুপুরে ভাঙনরোধে দ্রুত তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণের দাবিতে স্থল ইউনিয়ন বাসীর আয়োজনে নদীর তীরে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার সহস্রাধিক মানুষ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির পর থেকে ডান তীরে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। উত্তরে ছোট চোহালী থেকে চালুহারা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটারজুড়ে বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীতে চলে গেছে। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাসপাতালসহ বসতভিটা ও স্থাপনা। বিভিন্ন দফতরে বলেও বাঁধ নির্মাণ বা ভাঙন রোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।