নিকলীতে বালুখেকোদের তাণ্ডব

রাতের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি

দিনের আলোতে জমি দেখা গেলেও সকালে দেখা যায়, জমি যেন নদীর সাথে মিশে গেছে। এসব বালু ব্যবসায়ী ভৈরব এলাকার বৈধ বালিমহালের অজুহাতে রশিদ দেখিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করছে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জমি হারিয়ে জীবিকা ও চাষাবাদে হুমকির মুখে পড়েছেন।

আলি জামশেদ, নিকলী (কিশোরগঞ্জ)
Printed Edition
নিকলীতে নদী তীরবর্তী ফসলি জমি থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন
নিকলীতে নদী তীরবর্তী ফসলি জমি থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন |নয়া দিগন্ত

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার নদীর তীরবর্তী ফসলি জমিতে বালু খেকোদের তাণ্ডব চলছে। রাতের আঁধারে তারা লুটে নিচ্ছে কৃষকদের আবাদি জমির বালিমাটি। ফলে রাতেই হরিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। দিনের আলোতে জমি দেখা গেলেও সকালে দেখা যায়, জমি যেন নদীর সাথে মিশে গেছে। এসব বালু ব্যবসায়ী ভৈরব এলাকার বৈধ বালিমহালের অজুহাতে রশিদ দেখিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করছে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জমি হারিয়ে জীবিকা ও চাষাবাদে হুমকির মুখে পড়েছেন।

স্থানীয় প্রশাসনের নীরব ভূমিকা আর রাজনৈতিক আশ্রয়ে বালু খেকোরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যার ফলে প্রতিদিন নদী তীরের উর্বর কৃষি ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে, ভাঙছে বসতভিটা, নদীতীর, বিপন্ন হচ্ছে ফসল উৎপাদন, নষ্ট হচ্ছে জীবিকা। কৃষকদের দাবি দ্রুত আইন প্রয়োগ করে বালু দস্যুদের দমন করা হোক।

তাদের অভিযোগ, নিকলীর ঐতিহাসিক গোড়াউত্রা নদীর তীরবর্তী তোতারচর ও ননীর হাওর এলাকায় রাতভর চলে বালিমাটি উত্তোলন। ড্রেজার মেশিন দিয়ে ১৫-২০ ফুট গভীর করে জমি কেটে ফেলা হচ্ছে। এসব অপকর্মের পেছনে রয়েছেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি ও স্থানীয় দালালচক্র। ফলে ভুক্তভোগী কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। বাধা দিলেই হুমকি বা হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের।

ছাতিরচর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মালেক মিয়া বলেন, বিকেলে ফসলি জমি দেখি, সকালে দেখি সেই জমি নদীতে পরিণত হয়ে গেছে। আমার ১৫০ শতাংশ জমির মধ্যে ১২০ শতাংশই কেটে নিয়ে গেছে বালু দস্যুরা। কার কাছে বিচার দেব? তিনি জানান, জমিখণ্ডটি তিনি ৯০ হাজার টাকায় কিনেছিলেন কয়েক মাস আগে, এখন সে জমি পানির নিচে। একই এলাকার কৃষক আবুল কাশেম বলেন, আমাদের পুরো পরিবারের ১৫০ শতাংশ জমিই শেষ। কোথাও বিচার পাই না।

৯ নং ওয়ার্ডের কৃষক আরশ আলী বলেন, দেশে এখন যেন আইনের কোনো বালাই নেই! আমার বাবার কেনা ৬০ শতাংশ জমি বালু খেকোরা কেটে নিয়েছে। রাতে স্টিলবোটে করে বালু তুলে নিয়ে যায়, সকালে বিক্রি করে বাজিতপুরে নিয়ে। ছাতিরচর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি পরশ মাহমুদ জানান, ননী হাওরে তার পরিবারের জমিও রেহাই পায়নি। গতকালই আমার ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি, আমাদের ১০০ শতাংশ জমির বালুমাটি কেটে নিয়ে গেছে বালুখেকোরা। প্রশাসনের নজরদারির অভাবেই এমনটি হচ্ছে।

এ বিষয়ে ছাতিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান চৌধুরী ইয়ার খানকে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে গুরই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোতা মিয়া অভিযোগের বিষয়টি শুনেছেন বলে স্বীকার করেন। গুরই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি সভাপতি আবু তাহের বলেন, বালু কাটার খবর পেয়ে আলমাস ও আলীম উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করি। তারা বলে, বাজিতপুর উপজেলার কৈলাগ ও কুকড়া রায়ের কিছু লোক বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত।

স্থানীয় সূত্র জানায়, দৌলতপুর এলাকার আলমাস গংরা এ বালু ব্যবসার অন্যতম হোতা। যদিও আলমাস ফোনে বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এক সময় আমার নিজের জমি থেকে বালু বিক্রি করেছি। কিন্তু এখন এসবের সাথে জড়িত নই। তিনি দাবি করেন, নদীপথ দিয়ে অন্য এলাকার বোর্ড ও ড্রেজার মালিকরা এখানে এসে বালু কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, শত শত একর আবাদি জমি এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভয়ভীতির কারণে অনেকে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। এক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বলেন, ২৮ অক্টোবর রাতে ড্রেজার দিয়ে আমাদের জমি কেটে স্টিলবোটে বালু তোলার সময়কার ভিডিও রয়েছে। কিন্তু এই ভিডিও দেখিয়ে কার কাছে বিচার চাইবো?

এ বিষয়ে নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা মজুমদার মুক্তি বলেন, বালু উত্তোলনের বিষয়ে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। ইতঃপূর্বে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বৈধ রিসিট পাওয়া গিয়েছিল। তবে অবৈধভাবে বালুমাটি কাটা হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।