সিন্ডিকেট ভাঙার আড়ালে মানহীন বইয়ের আশঙ্কা

২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের পাঠ্যবই

বর্তমান কাগজের বাজার যাচাই করে যেসব লটের দর ২ টাকা ৫০ পয়সা (প্রতি ফর্মা) থেকে ২ টাকার নিচে রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে এনসিটিবি পুনঃমূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিলে মানসম্পন্ন বই পাওয়া সম্ভব। আর প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে ছাপার কাজ শুরু করতে পারলেই নির্ধারিত সময়ে বই দেয়া সম্ভব।

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তিনটি শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণে পুনঃদরপত্র আহ্বানে সরকারের ৩২১ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। আগের দরপত্রে যে দর প্রেস মালিকরা জমা দিয়েছিল সেখান থেকে রিটেন্ডারে বইয়ের দর অনেক কমেছে। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দামে মুদ্রণের কার্যাদেশ দেয়া হলে ২০২৬ সালের পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা প্রেস মালিকরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে দরে বই মুদ্রণের কাজ পেতে মরিয়া হয়ে দরপত্র জমা দিয়েছে তা বাজার দরের চেয়ে অনেক কম। এমনকি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নিজেরাই যে প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করেছে প্রেস মালিকরা তার চেয়ে ৪৫ শতাংশ কম দর দিয়ে বই ছাপতে দরপত্র দিয়েছে। ফলে প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গার আড়ালে নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে মানহীন পাঠ্যবই তুলে দেয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেকটা খরচ বাঁচাতে গিয়ে নিজের পায়ের মাপের চেয়ে ছোট সাইজের জুতা কেনার মতো অবস্থা হতে পারে আগামী বছরে।

এ বিষয়ে এনসিটিবি থেকেও আশঙ্কা প্রকাশ হয়েছে যে, সম্প্রতি ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণে বাতিল হওয়া দরপত্রের তুলনায় পুনঃদরপত্রের দর অনেক কম হওয়ায় ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপাতে সরকারের খরচ কমেছে প্রায় ৩২১ কোটি টাকা। কিন্তু এত কম দামে নির্ধারিত শর্ত মোতাবেক পাঠ্যবই দেয়া প্রেস মালিকদের জন্য শুধু বাড়তি চাপই নয় বরং অসাধ্যও বটে। আর এ কারণেই মূলত মানহীন বইয়ের আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা। পুরনো ও অভিজ্ঞ প্রেস মালিকদের অনেকেই জানান, পুনঃদরপত্র হওয়ায় সব প্রক্রিয়া শেষে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর বই ছাপা শুরু হতে আরো সময় লাগবে। অন্য দিকে ৯ম শ্রেণীর বই ছাপাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই এই শ্রেণীর বই ছাপা কবে শুরু হবে তা এখনো অনিশ্চিত।

সূত্র আরো জানায়, শুধু কম দাম দেয়ার মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো সফলতা নেই। পণ্যের কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে না পারলে পুরো অর্থটাই গচ্ছা যাবে। এবার পাঠ্যবই মুদ্রণে ক্ষেত্রেও সরকারের অর্থ সাশ্রয় করার মাধ্যমে কোনো সফলতা নিশ্চয়ই থাকবে না। শিক্ষার্থীদের হাতে যাতে ভালো বই পৌঁছানো যায় সেই চেষ্টাও থাকতে হবে। সরকার যেখানে প্রাক্কলিত দরের মাধ্যমে বইয়ের মুদ্রণ খরচের একটি খসড়া হিসেবে আগেই দিয়ে দিয়েছেন সেখানে তার চেয়েও কম দামে বই মুদ্রণের কোনো সুযোগ থাকলে নিঃসন্দেহে মানহীন বই শিক্ষার্থীদের হাতে চলে যাবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বিষয়ে খোদ এনসিটিবি সূত্রই বলছে, বই ছাপাতে কম দর ও প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে ছাপার কাজ শুরু হতে সময় বেশি লাগায় নতুন বছরের জানুয়ারিতে মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে। বর্তমান কাগজের বাজার যাচাই করে যেসব লটের দর ২ টাকা ৫০ পয়সা (প্রতি ফর্মা) থেকে ২ টাকার নিচে রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে এনসিটিবি পুনঃমূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিলে মানসম্পন্ন বই পাওয়া সম্ভব। আর প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে ছাপার কাজ শুরু করতে পারলেই নির্ধারিত সময়ে বই দেয়া সম্ভব। এনসিটিবি ও বই ছাপার সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণীর ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি বই ৩০০ লটে (প্রতি শ্রেণীতে ১০০ লট) ছাপার জন্য ২০৭ কোটি ফর্মা (৮ পৃষ্ঠা ১ ফর্মা হিসাবে) কাগজ প্রয়োজন হবে। এই তিন শ্রেণীর বাতিল হওয়া দরপত্রে দরদাতাদের দেয়া গড়ে দর ছিল ৩ টাকা ১৯ পয়সা (প্রতি ফর্মা)। কিন্তু সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদে এই ক্রয় প্রস্তাব বাতিল হওয়ায় ৩০০ লটের পুনঃদরপত্র সম্প্রতি উন্মুক্ত করা হয়। নতুন দরদাতারা প্রতি ফর্মায় আগের দরপত্রের তুলনায় গড়ে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৫০ পয়সা কমিয়েছেন। এতে ২০৭ কোটি ফর্মার বই ছাপাতে এনসিটিবি তথা সরকারের খরচ কমছে প্রায় ৩১০ কোটি টাকার বেশি। বই ছাপার সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি আগের (বাতিল) দরপত্রে প্রতি ফর্মার দর ৩ টাকা ১৯ পয়সা না হয়ে ২ টাকা ৭০ বা ২ টাকা ৮০ পয়সা হলে হয়তো এটি বাতিল হতো না। এতে প্রেসগুলোর মুনাফা ‘উচ্চ’ না হলেও মানসম্পন্ন বই দিয়েও ‘ভালো’ লাভ থাকত। তবে পুনঃদরপত্রে যেমন কম রেট পড়েছে তাতে এনসিটিবির স্পেসিফিকেশন (শর্ত) অনুযায়ী মানসম্পন্ন বই দেয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু ছাপার কাজ নজরদারির জন্য প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন এজেন্ট (পিডিআই) নিয়োগ এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় কাজ শুরু করতে পারেনি প্রেসগুলো। এ ছাড়া এবার অমর একুশে বইমেলা ডিসেম্বরে আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। বই ছাপার কাজ যারা করেন তাদের অনেকে বই মেলায়ও অংশ নেন। তবে শেষ মুহূর্তে বইমেলা স্থগিত হলেও বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাথমিকে মোটামুটি ঠিক থাকলেও আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।

দরপত্রে কম দর এবং বছরের শুরুতে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো নিয়ে গতকাল সোমবার এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই বিষয়গুলোর সাথে একমত হলেও গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে প্রাক্কলিত দর থেকে কমবেশি ৩০-৪৫ শতাংশ কম দর পড়ার কথা স্বীকার করে এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা শুরু থেকেই প্রেস মালিকদের কড়া নজরদারিতে রাখতে একাধিক টিম গঠন করেছি। এ ছাড়া এবারই প্রথম প্রত্যেকটি প্রেসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রেসগুলোতে ২৪ ঘণ্টা নজরে রাখা হচ্ছে। আমাদের চেষ্টা থাকবে সততা ও কঠিন নজরদারির মাধ্যমে মানসম্পন্ন বই পাওয়া নিশ্চিত করা হবে। আর সব বাধা অতিক্রম করে জানুয়ারিতে বই দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা।

প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর দিয়ে মুদ্রণ নিয়ে কারো কারো মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি থাকতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, বছরের শেষ সময়ে বইয়ের কোয়ালিটি যাচাই করার সুযোগ থাকে না। তখন শুধু বই গণনা করেই স্কুলে স্কুলে পাঠানো হয়। আর এই সুযোগে কিছু প্রেস মানহীন বই সাপ্লাই করেন। এই সুযোগ কেউ যাতে না পায় সেই উদ্যোগও নিতে হবে। এনসিটিবিতে গ্যারান্টি মানি ১০% জমা রাখার পরিমাণটাও বাড়িয়ে ৫০% করা যেতে পারে । যাতে কেউ খারাপ বই দিলে তাকে জরিমানা করার সুযোগ থাকে। আবার কিভাবে এত কম দরে বই দেবে প্রেস মালিকরা তারও সঠিক ব্যাখ্যা তলব করতে পারে এনসিটিবি। জবাব সন্তোষজনক না হলে পিপিআর অনুযায়ী পুরো টেন্ডারও বাতিল করার সুযোগ রয়েছে।