আমানুল্লাহ আদিব
রমজান মাস। সেদিন ১৮ রমজান। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে আল্লাহর সাথে গভীর আন্তরিকতাপূর্ণ দিন কাটছে তারেকের। হঠাৎ করেই তারেকের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ উঁকি দিলো। বাড়ির সামনে থেকে অজানা কারণে তুলে নিয়ে গেল র্যাব। পিতৃ-মাতৃস্নেহ বঞ্চিত যে তারেক স্বপ্ন দেখেছিল একদিন দেশসেরা ইঞ্জিনিয়ার হবে, সেই তারেকের চারটি বছর কেড়ে নিলো নির্মম আয়নাঘর। তারেকের কান্নাজড়ানো ভয়ার্তকণ্ঠে উঠে এসেছে সেইসব দুঃসহ দিনগুলোর করুণ চিত্র। হুবহু তুলে ধরছি তার আয়নাঘরের দিনলিপি :
গুম হওয়ার দিনটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারেক বলল, ‘২০১৭ সালের ১৪ জুন। সেদিন ছিল ১৮ রমজান। বিকেল আনুমানিক আড়াইটায় আমি কিছু অপরিচিত ব্যক্তিকে আমার বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখি। কৌতূহলবশত তাদের জিজ্ঞেস করি, ভাই আপনারা কোথায় যেতে চাচ্ছেন বা কাকে খুঁজছেন। তখন তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে রহিমের বাড়ি কোনটি। আমি বলেছিলাম এই পাড়াতে দু’জন রহিম আছে। তখন তারা আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করল। এই ঘটনা চলাকালীন ওই স্থানে তিনজন ব্যক্তি জড়ো হয়ে যায় যারা প্রত্যেকে অপরিচিত আগন্তুক। তাদের একজন বলতে থাকে এসো তাওহিদের পথে। এভাবে কথাবার্তা বলে তারা আমাকে কিছু একটা বোঝাতে চাচ্ছিল, কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমি আমার বাবা-মাকে ডাকতে থাকি। আমার বাবা-মা এবং ভাই বোনরা ঘর থেকে বেরিয়ে যখন তাদের জিজ্ঞেস করে আপনারা কারা। উত্তরে তারা বলে আমরা আপনার ছেলেকে নিয়ে যেতে এসেছি। কারণ সে জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত বলে আমরা ধারণা করছি। ততক্ষণে সিভিল ড্রেসে থাকা আরো কয়েকজন ব্যক্তি জড়ো হয়ে যায়। ওই বিষয়টি দেখে এলাকাবাসীরাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে শুরু করলে তারা আমার মা-বাবাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পুরা ফ্যামিলিকে বলে, কথা বললে ক্রসফায়ার করব এক এক করে সবগুলোকে। এরপর আমাকে একটা গাড়িতে তুলে কালো জমটুপি ও হাতকড়া পরিয়ে তুলে নিয়ে যায়। আমি জানতাম না আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পরবর্তীতে জানতে পারি আমাকে পতেঙ্গা র্যাব-৭ এ বন্দী করে রেখেছে।’
এরপর তারেকের সাথে তার পরিবারের আর যোগাযোগ হয়নি। কেউ জানে না তারেক কোথায়। বন্দিজীবন নিঃসন্দেহে যন্ত্রণাদায়ক। তারেকের ক্ষেত্রে সেটা কেমন ছিল? জানতে চাইলে তারেক বলে, ‘সেখানে আমাকে একটি কবরের মতো সেলরুমে ৫৯ দিন বন্দী করে রাখা হয়েছিল। যার দৈর্ঘ্য ৭ ফুট, প্রস্থ ৩ ফিট। যেখানে আমি ৩৯ দিন ধরে গোসল করার সুযোগ পাইনি। এই ৩৯ দিন আমাকে এক লুঙ্গিতে থাকতে হয়েছিল। গ্রেফতারের দুই দিন পর আমাকে নিয়ে র্যাব সদস্যরা বান্দরবান ক্যাসিং ঘাটা যায়। সেখান থেকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার জয়নুল আবেদীন নামক একজনকে গ্রেফতার করে র্যাব-৭ এ নিয়ে আসে। তাকেও জঙ্গিবাদের সাথে যুক্ত অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। কিন্তু এসবের কোনো সত্যতা না পেলে তারা আমাকে এবং জয়নুলকে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। পরবর্তীতে তারা আমাকে র্যাব-৭ থেকে চোখ হাত বেঁধে অন্যত্র নিয়ে যায়। সেখানকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এত বেশি ছিল যে শব্দ করে কোনো কথা বলা যেত না, এটি এমন একটি জায়গা যেখানে কখনো সূর্যের আলো পৌঁছায়নি। ২৪ ঘণ্টা হাতকড়া দিয়ে হাত বেঁধে রাখা হতো আর সবুজ কারারক্ষীর কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে রাখা হতো যেন আমরা মনে করি যে আমাদেরকে কোনো জেলখানায় কারারক্ষীরা বন্দী করে রেখেছে। অথচ এই গুমখানা তথা আয়নাঘরের সাথে কারাগারের কোনো সম্পর্ক নেই। এক পর্যায়ে বুঝতে পারি আমাদেরকে ঢাকা র্যাব হেডকোয়ার্টারের আশপাশে কোথাও রাখা হয়েছে।’
কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল তারেকের। দু’চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু বেয়ে পড়ছিল। তখন তারেকের কণ্ঠে এসব কথা শুনলে যে কারো বুক হুহু করে উঠতে বাধ্য। তারেক বলতে থাকল, ‘আমাদেরকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে স্পষ্টভাবে বিমান ল্যান্ড করা আর ওঠার শব্দ শোনা যেত। আমাদেরকে দিনে মাত্র চারবার প্রস্রাব পায়খানা করতে ওয়াশরুমে নেয়া হতো। এর বাইরে প্রস্রাব করতে চাইলে বেত্রাঘাত করত এবং ওয়াশরুমে যেতে দিত না। ফলে বাধ্য হয়ে যে সেলে ঘুমাতাম সেখানেই প্রস্রাব করতে হয়েছে বহুদিন। এমনও হয়েছিল যে, যে বোতলে পানি খেতাম সে বোতলে প্রস্রাব করতাম আবার বাথরুমে যাওয়ার সুযোগ হলে প্রস্রাব ফেলে দিয়ে পানি ঢুকিয়ে আবার সেই বোতলে পানি পান করতাম। যদি চোখের কাপড় কখনো ঢিলে হয়ে যেত তাহলে মারধর করত। গালি ছাড়া তারা কথা বলত না। সেখানকার সবচেয়ে ভালো কথা ছিল ‘শালার পুত’। সেখানে আমাকে এভাবে সাড়ে তিন বছর বন্দী করে রাখা হয়েছিল। জয়নুল আবেদীনের সাথে একদিন সেখানে আমার কথা হয় যখন প্রহরীরা একটু দূরে ছিল। তখন জয়নুল আবেদিন আমাকে জানায় যে তাকে সেখানে র্যাব-৭ থেকে পাঁচ মাস পর নিয়ে আসা হয়েছিল। ২০১৯ সালে জয়নুল আবেদীনকে সেখান থেকে কোথাও যেন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটা ছিল আমার সাথে জয়নুল আবেদীনের শেষ দেখা। এখন পর্যন্ত জয়নুল আবেদিন কোথায় আছে তার কোনো হদিস মেলেনি।’
তারেক আরো বলল, ‘এটা সেই জায়গা যে জায়গায় ব্যারিস্টার আরমানকে একটি বাথরুমে রাখা হয়েছিল। যদিও জায়গাটি একটি ভবনের মধ্যে অবস্থিত কিন্তু আমাকে রাখা হয়েছিল একটি সেলরুমে। তাই আমরা কখনো একে অপরকে চিনতে পারিনি কিন্তু অভ্যন্তরীণ বন্দীদের রোলিং এর মাধ্যমে এ খবরটি জানতে পেরেছিলাম যে সেখানে ব্যারিস্টার আরমান রয়েছে। এভাবে চোখ হাত বাঁধা নির্মম নির্যাতনের পর ২০২০ সালের ১৯ জুন আমাকে র্যাব-১৫ তে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০ জুন ২০২০ তারিখে আমাকে ফুলবাড়িয়া থানায় অত্র এলাকার ডক্টর মামুন মাদানী নামক এক আলেমের সাথে নাটকীয় মামলা সাজিয়ে মামলা করে। বন্দী অবস্থায় র্যাবের অনেক সদস্য আমাকে বলত আমরা জানি তোমাদের এখানে নির্দোষ অবস্থায় গ্রেফতার করে আনা হয়েছে তোমরা কোনো দোষ করনি। কিন্তু আমাদেরকে সরকারের নির্দেশ অবশ্যই মানতে হচ্ছে কারণ আমরা হুকুমের গোলাম।’
তারেক বলে, ‘আমি অনেক পুলিশ এবং র্যাব সদস্যকে এটাও বলতে শুনেছিলাম যে, এভাবে সরকার আর কত নির্দোষ ব্যক্তিকে ধ্বংস করবে। থানা থেকে আমাকে এবং মামুন মাদানীকে ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এর ভিতর অসংখ্যবার জামিনের চেষ্টা করলেও প্রথম আসামি হওয়ার পাঁচ মাস পর মামুন মাদানী জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে প্রহসন যেন থামছিলই না। অনেক দুঃখ-কষ্ট, অনেক বৃষ্টি-ঝড়ের দিনরাত পেরিয়ে জেল থেকে ছাড়া পাই দশ মাস পর। আয়নাঘরের সাড়ে তিন বছরের নির্যাতনের পর আরো ১০ মাস আমাকে শারীরিক মানসিক নির্যাতন করেছিল তারা।’