বিশেষ সংবাদদাতা
গায়েবি মামলার সংস্কৃতি দেশের পুরো ব্যবসার পরিবেশকে একধরনের গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। এতে একধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এটার পরিবর্তন আনার জন্য অর্থ উপদেষ্টা বাজেটে কিছুই রাখেননি বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। সিপিডি বলছে, বাজেট সামগ্রিকভাবে চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারলে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের জন্য স্বস্তি আনতে পারত। আলোচকরা বলছেন, দেশের চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। কিছু রাজস্ব পদক্ষেপ বাজেটের মূল প্রতিপাদ্যের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সংলাপে এ কথা কলা হয়। সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। আলোচনায় অংশ নেন বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এনামুল হক খান, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, বস্ত্রকলের মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। আরো বক্তব্য দেন সোশ্যালিস্ট লেবার ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি দৌলত আক্তার।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, শুক্রবার চট্টগ্রাম থেকে একজন জানালেন, তার নামে আরেকটা মামলা হয়েছে হত্যা মামলা। ১১০ জন আসামি, উনি ৯৫ নম্বর। এভাবে গায়েবি মামলা হওয়ায় কে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, সেটি আলাদা করতে পারছি না। আমরা একটা ‘ব্ল্যাঙ্কেট সাসপিশনে’র (সামগ্রিক সন্দেহ বা একজনের অপরাধে সবাইকে সন্দেহ) পর্দা পুরো সমাজের ওপর ঢেলে রেখেছি। এ অবস্থায় সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকা ও ভুক্তভোগী হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তিনি বলেন, বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটাতে শুধু অর্থ মন্ত্রণালয় নয়, পুরো সরকার ব্যবস্থাকেই কাজ করতে হবে। স্বরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিচার বিভাগসহ প্রতিটি মন্ত্রণালয় যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে হবে না। এসব বিষয়ে আমাদের রেগে যাওয়ার সময় হয়েছে। এটি অযৌক্তিক রাগ নয়। আমি এটাকে বলব পবিত্র রাগ। যে রাগের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করতে হয়। এখন ওই রেগে যাওয়ার মুহূর্ত হয়েছে। কারণ এ সরকারের মধ্যে একটা পিকুলিয়ার সিনড্রোম (উদ্ভট লক্ষণ) দেখতে পাচ্ছি। আমি বলব, একটি নতুন ধরনের কুম্ভকর্ণ ‘সিনড্রোম’, শোনে কিন্তু সাড়া দেয় না।
বাজেটে বড় কোনো সিদ্ধান্তের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করছি উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর বলেন, অনেকে বলছেন বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে চারজন অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। তারপরও কেন গতানুগতিক বাজেট হলো? আমি মনে করি উপদেষ্টা পরিষদের সবাই অর্থনীতিবিদ হলেও ব্যতিক্রম কিছু হতো না। কারণ বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে যে সাহস দেখাতে হয়, সেটির জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, শুধু আকারে ছোট হয়েছে, এদিক থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটটি ব্যতিক্রম। বাজেটে মানুষের জন্য যেসব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে, সে অনুযায়ী পদক্ষেপের আলোচনা নেই। সার্বিকভাবে বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দিকনির্দেশনা দিতেও বাজেট ব্যর্থ হয়েছে। এসব বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি আগামী মাস পরে মধ্যবর্তী পর্যালোচনা করার প্রস্তাব দেন তিনি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাস্তবতার নিরিখে এ বাজেট বড়। তবে অর্থনৈতিক প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। এ ছাড়াও এ বাজেট পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এটি বাজেটের মূলদর্শনের সাথে সাংর্ঘষিক। কারণ, বাজেটের লক্ষ্য সম্পদ পুনর্বণ্টন। অর্থাৎ ধনীদের কাছ থেকে কর নিয়ে গরিবদের দেয়া হবে। কিন্তু পরোক্ষ কর বাড়লে দরিদ্রদের ওপর করের বোঝা চাপে।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ে দেখেছি; কিন্তু এবার আগের তুলনায় সাত হাজার কোটি টাকা কমেছে। প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটাতে পারেনি বর্তমান সরকার। তিনি বলেন, পুরোনো সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু করতে দেখলাম না এবারের বাজেটে। বাজেট সরকারের চরিত্র উদঘাটন করে। সরকার কি জনগণের কল্যাণ চায়, নাকি লুটেরাদের সহায়তা করতে চায়- তা বাজেটেই বোঝা যায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বিনিয়োগ আসবে না, হবে না। বর্তমান সরকারের আমলটা অনিশ্চিত, কারণ কতদিন থাকবে সেটা বোঝা যায় না। তাই বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ বলেন, আমরা অনেক অস্বস্তিকর সময় পার করছি। বর্তমানে আমরা দেখছি খুব সুন্দর সুন্দর মডেল তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে একটা মডেল হচ্ছে, কেউ লুট করলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই লুটের টাকা আবার ব্যাংকে পৌঁছে দিয়ে আসে। ব্যাংকগুলো লুট করেছে, আর আমরা তার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি চড়া সুদহার দিয়ে। আমার থেকে আপনি (সরকার) বাড়তি টাকা নিয়ে এ চুরির টাকার ভর্তুকি দেবেন, এটা হয় না। এখন পর্যন্ত একটা ব্যাংকের কর্মকর্তার জেল হয়নি, একজন গ্রাহকেরও (দোষী) জেল হয়নি। কারণ যার কাছে টাকা, যে যত বড় চোর, সে তত বড় স্বচ্ছ, এটারই আমরা প্রতিফলন দেখছি।
অন্যরা বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর একটা বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। তবে দেশের চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। কিছু রাজস্ব পদক্ষেপ বাজেটের মূল প্রতিপাদ্যের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাজেটে ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তে মানুষের ওপর অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে যথাযথ বরাদ্দ বা পদক্ষেপ নেই। তবে বাজেটে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে। এগুলো হলো কর ছাড়, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ ও প্রণোদনা এবং ক্ষতিকর কার্যক্রমে উচ্চ কর আরোপ।