বিদ্যুৎ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবেশে অগ্রগতি হলেও বাড়ছে ঝুঁকি

এমআইসিএস ২০২৫ প্রতিবেদন

বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও, পরিবার কাঠামোর ভাঙন, অভিবাসনজনিত সামাজিক চাপ, পরিবেশগত ঝুঁকি এবং শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাংলাদেশের শিশু, নারী ও গৃহস্থালি খাতের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০২৫। তিন দশকের বেশি সময় ধরে পরিচালিত এই জরিপের সর্বশেষ সংস্করণে উঠে এসেছে দেশের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, নিরাপদ পানি, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পাশাপাশি নতুন কিছু উদ্বেগজনক বাস্তবতা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এ জরিপে ৬২ হাজারের বেশি পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা দেশের ৬৪ জেলা ও ৮টি বিভাগের বাস্তব পরিস্থিতির সর্বাধিক তুলনাযোগ্য চিত্র তুলে ধরেছে।

বিদ্যুৎ সুবিধায় প্রায় সর্বজনীন প্রবেশাধিকার : সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ৯৮.৩ শতাংশ পরিবার এখন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, যেখানে ২০১২-১৩ সালে এই হার ছিল মাত্র ৬১.৫ শতাংশ। গ্রাম অঞ্চলেও এখন প্রায় সর্বত্র বিদ্যুৎ পৌঁছেছে, যা দেশের অবকাঠামোগত অগ্রগতির একটি বড় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

শিশুদের পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তন : জরিপে দেখা গেছে, ৪.৬ শতাংশ শিশু এখন বাবা-মা ছাড়া বসবাস করছে (২০১৯ সালে ছিল ৪.১ শতাংশ)। অন্তত একজন অভিভাবক বিদেশে বসবাস করছে এমন শিশুর হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৬ শতাংশে, যা ২০১২-১৩ সালে ছিল মাত্র ৪.৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

শিশু মৃত্যুহার কমলেও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে : পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে নবজাতকের মৃত্যুহার এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। নবজাতক মৃত্যুহার ২০১৯ সালে ছিল ২৬ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে ২২ এ নেমে এসেছে। শিশু (১ বছরের কম) মৃত্যুহার ২০১২-১৩ সালে ছিল ৪৬ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ৩৪ এবং ২০২৫ সালে ২৯ শতাংশ নেমে আসে। পাঁচ বছরের কম মৃত্যুহার ২০১২-১৩ সালে ছিল ৫৮ শতাংশ যা ২০১৯ সালে ৪০ এবং ২০২৫ সালে ৩৩ নেমে আসে।

পানি নিরাপত্তা ও ভারী ধাতু পরীক্ষায় বড় উদ্যোগ : এই জরিপের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে র‌্যাপিড ওয়াটার কোয়ালিটি টেস্ট এবং ভারী ধাতু (লেড) ও এনিমিয়া পরীক্ষার উদ্যোগ। ৬ হাজার ১০৬টি পরিবারের পানির মান পরীক্ষা করা হয়েছে (আর্সেনিক, ই. কোলাই ও লবণাক্ততা)। ১০ হাজার ৬৬৭ জন শিশুর রক্তে সিসা ও অ্যানিমিয়ার পরীক্ষা করা হয়েছে। ১ হাজার ৯৪০ জন গর্ভবতী নারীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি জনস্বাস্থ্য নীতির ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

শিক্ষা ও শিশু সুরক্ষায় অসমতা বাড়ছে : প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার বাড়লেও শহর-গ্রাম, ধনী-দরিদ্র ও প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে শেখার সুযোগে বড় ধরনের বৈষম্য রয়ে গেছে। জরিপ বলছে, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলো ন্যূনতম শেখার দক্ষতা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা : অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে- বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও, পরিবার কাঠামোর ভাঙন, অভিবাসনজনিত সামাজিক চাপ, পরিবেশগত ঝুঁকি এবং শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এমআইসিএস ২০২৫ জরিপ বলছে- বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারায় এগোলেও টেকসই মানব উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও শিশুর মানসিক সুরক্ষায় আরো সমন্বিত ও লক্ষ্যভিত্তিক উদ্যোগ জরুরি।

এই প্রতিবেদন নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য একটি বাস্তব ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।