এক সময়ের পাকিস্তানি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর নাটকে এমন নারী চরিত্র, যারা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, মতপ্রকাশে স্বাধীন এবং আবেগগতভাবে পরিপক্ব তারা ভালোবাসার মানে বোঝাতে গিয়ে কখনও নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতেন না। প্রেম ছিল বোঝাপড়ার জায়গা থেকে, আধিপত্য বা জোর-জবরদস্তির জায়গা থেকে নয়।
‘ধূপ কিনারে’ নাটকে ডা: জোয়া আলী খান ছিলেন এমনই এক চরিত্র- একজন আত্মবিশ্বাসী তরুণ চিকিৎসক, যিনি নিজেকে পুরুষের ছায়া হিসেবে নয়, সমানভাবে একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতেন। তার প্রেম ছিল সাহসিকতায় পূর্ণ, স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। তার বিপরীতে ডা: আহমের চরিত্রে ছিল এক পরিপক্ব পুরুষ, যে নিজের শৈশবের ট্রমা সামলে নিয়ে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি বজায় রেখেছে।
তেমনই ‘অঙ্খাহি’তে সানা মুরাদ চরিত্রটি ছিল এক বাস্তববাদী তরুণী, যিনি বাবার মৃত্যুতে পরিবার চালানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার কর্মক্ষেত্রে ভুলগুলো ছিল মানবিক, কখনো উপহাসের বিষয় হয়নি। সে ছিল প্রেমিকের আগ্রাসনের শিকার নয়, বরং নিজের চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া এক সচেতন নারী।
এইসব গল্পে নারী-পুরুষ উভয়েই ছিল আবেগপ্রবণ, তবে কেউ কারো ক্ষতি করত না। সম্পর্কের ভিত্তি ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি। কিন্তু সময় বদলেছে। এখনকার পাকিস্তানি নাটকে নারী চরিত্র যেন হয়ে উঠেছে সহিষ্ণুতা আর আত্মবিসর্জনের প্রতীক। আজকের ‘নায়িকা’ তার প্রেমিকের হাত থেকে কবজি ধরা, হুমকি, অপমান- সব কিছু নিঃশব্দে সহ্য করে। আর এই সহিংসতাই এখন নাটকের ভাষায় ‘ভালোবাসা’।
সম্প্রতি প্রচারিত ‘মান্ন মাস্ত মালাং’ নাটকে দেখা যায় নায়ক কবির তার প্রেমিকাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে, যাতে সে পালিয়ে না যেতে পারে। পরে বলে, ‘তা হলে আমি তোমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাব।’ এই দৃশ্যকে রোমান্টিক আবহে উপস্থাপন করা হয়। অথচ এটি একটি স্পষ্ট অপরাধমূলক আচরণ। একই ধরনের চরিত্র দেখা যায় ‘কাইসি তেরি খুদগারজি’ নাটকে, যেখানে নায়ক শামশের একটি মেয়ে মেহাককে হয়রানি করে, তাকে প্রত্যাখ্যান করার পরও জোর করে বিয়ে করে নেয়। নাটকের শেষদিকে তাকে প্রেমের আদর্শরূপে তুলে ধরা হয়, যেন সব ভুল ধুয়ে-মুছে গেছে।
এই ধারায় একাধিক নাটকে পুরুষ চরিত্রকে দেখানো হয় অধিকার প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে- যে প্রেমের নামে নারীর উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালায়। অন্য দিকে নারী চরিত্র ধীরে ধীরে নায়কের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, নিজের মতামত বা স্বকীয়তা বিসর্জন দেয়। যেন ভালোবাসার প্রকৃত সংজ্ঞাই হয়ে উঠেছে ত্যাগ, সহ্য আর নীরবতা।
‘তেরে বিন’ নাটকে এমন এক জমিদার নায়কের দেখা মেলে, যে নায়িকাকে বারবার হেয় করে, তবু শেষমেশ সে-ই হয়ে ওঠে তার প্রেমের ‘নির্বাচিত’ সঙ্গী। নাটকে এমনকি বৈবাহিক ধর্ষণের ইঙ্গিতও ছিল, যা পরে প্রযোজকরা ‘মিসান্ডারস্ট্যান্ডিং’ বলে অস্বীকার করেন। এরকম একটি সংবেদনশীল বিষয়ের এমন অবজ্ঞা শুধু ভয়াবহ নয়, সামাজিকভাবে বিপজ্জনকও।
‘কারয-এ-জান’ নাটকে একজন ধর্ষক, খুনি ও ব্ল্যাকমেইলার চরিত্রের ‘রিডেম্পশন আর্ক’ দেখানো হয় এমনভাবে, যেন তার শৈশবের ট্রমা সব অপরাধকে ন্যায্যতা দেয়। আর নায়িকা এত অপরাধ সহ্য করার পর প্রতিক্রিয়া দেখায় কেবল তখনই, যখন সে তার ঘনিষ্ঠ একজনকে হত্যা করে।
২০১৯ সালে প্রচারিত ‘মেরে পাশ তুম হো’ নাটকে নারীর পছন্দের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ নেতিবাচকভাবে দেখানো হয়। একজন নারী যিনি নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে অন্য কাউকে বেছে নিয়েছেন, তাকে ‘দো টাকায় কি আওরত’ বলে অবমাননা করা হয়। পুরুষ চরিত্রের অহঙ্কার, অভিমান ও অভিশাপকে মহৎ বলে তুলে ধরা হয়, যেন পুরুষতন্ত্রই নৈতিকতার শেষ কথা।