- ভ্যাটে জোয়ার ষ কাস্টমসে মন্দা
- আয়করে পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে অভ্যন্তরীণ বাজার ঘুরে দাঁড়ালেও আমদানিনির্ভর রাজস্বে ধস অব্যাহত রয়েছে। এতে বাংলাদেশের রাজস্ব কাঠামো যে দীর্ঘদিন ধরে ‘আমদানিনির্ভর’ পথে আটকে ছিল তা অভ্যন্তরমুখী হতে শুরু করেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব চিত্র বলছে- একটি ধীর কিন্তু দৃশ্যমান কাঠামোগত পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ভ্যাট সংগ্রহের জোরালো প্রবৃদ্ধি এবং আয়কর ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার সামান্যই হলেও ইতিবাচক সাড়া নির্দেশ করছে যে অভ্যন্তরীণ বাজারে লেনদেন বাড়ছে; তবে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কাস্টমস রাজস্বে উল্লেখযোগ্য পতন সরকারের জন্য বড় সতর্ক সঙ্কেত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসের রাজস্ব ডেটা একটি বড় অর্থনৈতিক বার্তা দেয় যে- বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থা ‘আমদানিনির্ভর’ থেকে ধীরে ধীরে ‘অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর রাজস্ব কাঠামো’তে রূপান্তরিত হচ্ছে। এটি দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে শুভ, কিন্তু পথটি সহজ নয়। চট্টগ্রামে সংগ্রহ ধস, ব্যক্তি খাতে আয় সঙ্কোচন এবং করজালের সীমাবদ্ধতা- সব মিলিয়ে সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
তবে ইতিবাচক দিক হলো- ভ্যাটে জোয়ার, ডিজিটাল কর ব্যবস্থার দ্রুত বিস্তার, ও আয়কর সংগ্রহের পুনরুদ্ধার- সবই নির্দেশ করছে যে অর্থনীতি ধীরে ধীরে গতিশীল হচ্ছে এবং সঠিক নীতি-সহায়তা পেলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব নয়।
ভ্যাট হয়ে উঠছে রাজস্ব কাঠামোর মেরুদণ্ড : ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ভ্যাট আয় দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ২৪.৭৮% বেশি। এ প্রবৃদ্ধির তিনটি গভীর কাঠামোগত কারণ রয়েছে- প্রথমত. ই-ভ্যাট ও ই-ইনভয়েসিং দ্রুত প্রসার। ডিজিটাল রসিদ, অনলাইন ভ্যাট রিটার্ন ও নতুন ই-ইনভয়েস বাধ্যতামূলক হওয়ায় মুদিদোকান থেকে ইলেকট্রনিকস পর্যন্ত ভ্যাট নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়েছে। দ্বিতীয়ত. খুচরা বাজার ও সেবা খাতে লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। মহামারী-পরবর্তী ধাক্কা কাটিয়ে সেবা খাত (হাসপাতাল-হোটেল-রেস্টুরেন্ট-ই-কমার্স) এখন রাজস্ব বৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি।
তৃতীয়ত. ভ্যাট অডিট শক্তিশালী হওয়া। ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা পশ্চিম ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে অডিটনির্ভর ভ্যাট আহরণ নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, যেখানে কিছু অঞ্চলে ৩০%-৫০% পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। এ প্রবণতা ভ্যাটকে দেশের সংগঠিত রাজস্ব কাঠামোর মানুষের মতো মেরুদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।
কেন চট্টগ্রাম ভেঙে পড়েছে : কাস্টমস রাজস্ব চার মাসে বেড়ে ৪১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা হলেও প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪.৫৩%। এ দুর্বলতার মূল আঘাতটি এসেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ থেকে, যার জুলাই মাসের সূচনা ছিল ২৭% নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে।
কাস্টমসে ধসের তিনটি কারণ রয়েছে। ১. এলসি খোলায় স্ট্রাকচারাল পতন, আমদানি মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের ঘাটতি ও ব্যাংকগুলোর কঠোর এলসি নীতি- এসব মিলিয়ে আমদানি কমেছে প্রায় ২০%।
২. ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমে যাওয়া : গাড়ি, বিলাসপণ্য ও ভোক্তাপণ্য, যা কাস্টমস শুল্কের বড় উৎস- এই তিন খাতেই আমদানি সঙ্কুচিত।
৩. উৎপাদনমুখী ব্যবসা ‘অপেক্ষারত’: রাজনৈতিক পরিবর্তন-পরবর্তী পুনর্গঠনের মধ্যেও অনেক ব্যবসায়ী বড় আকারে আমদানির পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছেন।
বাংলাদেশের রাজস্ব কাঠামোতে কাস্টমসের শেয়ার ঐতিহাসিকভাবে ৩০%-৩৫%। কিন্তু এটি ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, “চট্টগ্রাম দুর্বল থাকলে জাতীয় রাজস্ব লক্ষ্য অর্জন সবসময় কঠিন।”
কাঠামোগত দুর্বলতার মধ্যেই আয়করে পুনরুদ্ধার : চার মাসে আয়কর রাজস্ব দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ০৪৩ কোটি টাকা, যা প্রবৃদ্ধি ১৬.১১%। এতে ইতিবাচক দিক হলো- ২০ লাখের বেশি করদাতার ই-রিটার্ন দাখিল, বড় করদাতা ইউনিটতে (এলটিইউ) অডিট বাড়ায় বড় করপোরেট ট্যাক্স বৃদ্ধি এবং রিয়েল-টাইম ই-ট্যাক্স সিস্টেম জনপ্রিয় হচ্ছে। এই ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও দুর্বলতাগুলো আরো গভীর। করজাল এখনো সঙ্কীর্ণ; মাত্র ৩০-৩৫ লাখ সক্রিয় করদাতা, ব্যক্তি খাতের আয় সঙ্কোচন এবং এসএমই খাত আয়কর দিতে অনীহা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে- “ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে ভ্যাট বাড়ছে। কিন্তু আয়কর মূলত প্রয়োগের কারণে বাড়ছে, মানুষ ধনী হওয়ার কারণে নয়।”
অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য : রাজস্ব কাঠামোর ‘অসমতা’: এনবিআরের ডেটা অনুসারে অত্যন্ত শক্তিশালী অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঢাকা পশ্চিম : +৫০.৭০%, ঢাকা দক্ষিণ : +১৪.৯০%, ময়মনসিংহ : +২১.৭৯%, রাজশাহী : +২০.০৬%, দুর্বল বা সঙ্কটাপন্ন অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস : ২৭% (জুলাই), চট্টগ্রাম কর অঞ্চল : ৪.১৩% (৪ মাস), খুলনা, বরিশালের কর অঞ্চল : নি¤œ প্রবৃদ্ধি
এর কারণ- অর্থনৈতিক কেন্দ্রভূমি ঢাকায় পুনরুদ্ধার দ্রুত, কিন্তু বন্দরনির্ভর অঞ্চলগুলোতে চাপ অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজস্ব কাঠামো কোথায় যাচ্ছে : এই অর্থবছরের ডেটা স্পষ্টত দেখায়- আমদানিনির্ভর রাজস্ব থেকে ভ্যাট-নির্ভর কাঠামোর দিকে রূপান্তর ঘটছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক, কারণ- বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কায় আমদানি অস্থির, ভ্যাট অভ্যন্তরীণ বাজারের স্বাস্থ্য নির্দেশ করে এবং আয়কর প্রগতিশীল কর কাঠামোর ভিত্তি। এর পাশাপাশি করজালের সম্প্রসারণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। যদি কর প্রদানকারী ব্যক্তির সংখ্যা ১ কোটি না ছাড়ে, তবে রাজস্ব কাঠামো টেকসই হবে না।
কর আদায়ে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো- ডিজিটাল কর-ব্যবস্থায় আস্থা বাড়ছে। ই-রিটার্ন, ই-পেমেন্ট, ই-ভ্যাট- এই তিন স্তম্ভ ২০২৫-২৬ অর্থবছরকে ‘ডিজিটাল রাজস্ব ট্রান্সফরমেশনের বছর’ হিসেবে চিহ্নিত করে।
সামনে যেসব ঝুঁকি মোকাবেলা জরুরি : সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চট্টগ্রাম ও আমদানিনির্ভর অঞ্চলের দুর্বলতা কাটাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যদি আমদানি তিন মাস পরেও না বাড়ে, কাস্টমস রাজস্ব লক্ষ্য ঘাটতি আরো বাড়বে। এর পাশাপাশি বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটাতেও পদক্ষেপ নিতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ কমলে করপোরেট ট্যাক্সও কমে যাবে। একই সাথে ভ্যাটে উচ্চ প্রবৃদ্ধি টেকসই কিনা সেটিও বিবেচনায় আনতে হবে। যদি ভোগ কমে যায় বা মূল্যস্ফীতি বাড়ে, ভ্যাট আয় ধাক্কা খেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন রাজস্ব কাঠামো স্থিতিশীল হলে করজাল বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। ৭৫ লাখ নতুন করদাতা যুক্ত করা জরুরি। এ জন্য জাতীয় আইডিভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় কর- ইনটিগ্রেশন কার্যকর করতে হবে। এ জন্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আমদানিকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। ডলার সঙ্কট সমাধান, এলসি নীতি সহজীকরণ, ট্যারিফ আধুনিকায়ন করতে হবে।
সারা দেশে ই-ট্যাক্স সিস্টেম বাধ্যতামূলক করা হলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। স্বচ্ছতা বাড়লে কর ফাঁকি ২৫% কমবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। এ জন্য উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের অনলাইন অডিট শক্তিশালী করার বিষয়ও বিবেচনা করা যেতে পারে। দেশে এখনো ৫,০০০-এর বেশি উচ্চ আয় শ্রেণি কর এড়ায়- এখানে বড় রাজস্ব সম্ভাবনা রয়েছে।



