বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে রফতানি খাতে বিপর্যয়

শাহ আলম নূর
Printed Edition
  • পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত
  • কুরিয়ার জট ছাড়াতে হিমশিম সংশ্লিষ্টরা

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (এইচএসআইএ) আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে দেশের রফতানিমুখী শিল্পে, বিশেষ করে তৈরী পোশাক (আরএমজি) খাতে, উৎপাদন কার্যক্রমে বড় ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। একই সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশের রফতানি শিল্পকে রক্ষায় সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ দরকার বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

তারা বলছেন, এই মুহূর্তে বিমানবন্দরে প্রায় ৫০০ টন কুরিয়ারজাত পণ্য আটকা রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে মধ্যে তৈরী পোশাকের নমুনা, ডিজাইন উপকরণ, কাঁচামাল ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র রয়েছে। যা এখনো বিমানবন্দরের প্রাঙ্গণে পড়ে রয়েছে। এসব পণ্য ডেলিভারি না হওয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাতটির উৎপাদন ও অর্ডার বাস্তবায়ন উভয়ই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তথ্যে দেখা যায়, অক্টোবরের ১৮ তারিখে কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনে একাধিক গুদামঘর পুড়ে যায়। সেই আগুনে বিদেশী কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আসা বিপুল পরিমাণ পণ্য সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নষ্ট হয়। এরপর থেকে নতুন করে আসা চালানগুলোও জমতে থাকে বিমানবন্দরের আঙিনায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিমানবন্দর এখন পণ্যজটে পূর্ণ একটি অচল স্থানে পরিণত হয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কুরিয়ার সেবার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিদেশী ক্রেতারা সাধারণত স্যাম্পল, প্যাটার্ন, কাপড়ের টুকরো, লেবেল ও প্যাকেজিং উপকরণ বিমান যোগে দ্রুত পাঠান। এসব পণ্য ছাড়া নতুন অর্ডার বা উৎপাদন শুরু করা সম্ভব নয়। প্রতিদিন গড়ে ৫০ টনের বেশি কুরিয়ার পণ্যবাহী বিমান ঢাকায় আসে। এর বড় অংশই পোশাক খাতের জন্য নির্ধারিত থাকে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

তারা বলছেন অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে এই সমস্ত চালান আটকে আছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক কারখানার উৎপাদন স্থগিত রয়েছে। কিছু কারখানা অর্ডার ডেলিভারির সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ জানাতে বাধ্য হয়েছে, আবার কেউ কেউ ক্ষতিপূরণের আশঙ্কায় রয়েছেন। বম্বিনো এক্সপ্রেস সার্ভিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিম মাহফুজ রায়ান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণে ১৯ অক্টোবরের পর থেকে তারা কার্গো এলাকায় ঢুকতে পারেনি। সেখানে প্রায় ৫০০ টন কুরিয়ার পণ্য আটকা রয়েছে। এর অধিকাংশই পোশাক খাতের স্যাম্পল ও কাঁচামাল। এই বিলম্ব রফতানিমুখী শিল্পে বড় ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

এদিকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি) জানিয়েছে, আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় অবকাঠামো মেরামত, নিরাপত্তা যাচাই এবং নতুন কার্যক্রম নির্দেশিকা (এসওপি) তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কুরিয়ার বিভাগ পুনরায় চালু করা সম্ভব নয়। একজন সিএএবি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন সেবাগুলো স্বাভাবিক করতে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও যন্ত্রপাতি সংস্কার না করে কিছু করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে বাংলাদেশ কাস্টমস এ বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছে। কাস্টমস কমিশনার তার টিমকে ২৪ ঘণ্টা কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে আটকে থাকা পণ্যগুলো দ্রুত উদ্ধার ও হস্তান্তর করা যায়। তবে কুরিয়ার সার্ভিস অপারেটরদের অভিযোগ, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে কোনো দ্রুত পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত কার্গো শেড বর্তমানে অচল। ফলে কুরিয়ার অপারেটররা অন্য একটি শেড ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু সিএএবি চেয়ারম্যান স্পষ্ট করে জানান, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো নিরাপদ নয়, তাই নতুন করে সেখানে কোনো কার্যক্রম চালানো যাবে না।

সাধারণত কুরিয়ার চালানগুলো সম্মিলিত আকারে আসে, পরে কাস্টমস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আলাদা আলাদা করে ছাঁটাই ও ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কুরিয়ার কর্মীদের ব্যক্তিগত প্রবেশপত্র (অ্যাকসেস পাস) ইস্যু করা হয়নি। ফলে কারও পক্ষে ভেতরে ঢুকে পণ্য উদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না। এক আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি বলেন, তাদের হাতে কয়েক হাজার চালান আটকে আছে। এরমধ্যে অনেক নথি, ডিজাইন, কাঁচামাল ও ব্যবসায়িক নথিপত্র রয়েছে। সরকার ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যাবে।

বস্ত্র ও পোশাক প্রস্তুতকারক সংগঠনগুলো বলছে, এই বিলম্বের কারণে শুধু অর্থনৈতিক নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর সুনামেও ধাক্কা লাগছে। বিদেশী ক্রেতারা সময়মতো স্যাম্পল না পাওয়ায় নতুন অর্ডার দিচ্ছেন না, কেউ কেউ বিকল্প দেশ যেমন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা ভারত থেকে পণ্য সরবরাহ নিচ্ছেন। এক রফতানিকারক বলেন, স্যাম্পল একদিন দেরিতে পৌঁছালেও ক্রেতার আস্থা নষ্ট হয়। এখন যখন সপ্তাহজুড়ে কোনো চালানই হাতে আসছে না, তখন নতুন অর্ডার পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা-বেবিচক কাস্টমস ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করছি। বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করা দরকার, কারণ এটি শুধু পোশাক খাত নয়, পুরো রফতানি ব্যবস্থার সাথেই জড়িত। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের রফতানি লজিস্টিক ব্যবস্থার দুর্বলতা উন্মোচন করেছে। দেশে এমন কোনো বিকল্প স্টোরেজ ও রিজার্ভ কুরিয়ার সেন্টার নই, যা জরুরি অবস্থায় ব্যবহার করা যায়। ফলে এক জায়গায় অগ্নিকাণ্ড ঘটলে পুরো চেইন অচল হয়ে পড়ে।

তারা মনে করেন, বিমানবন্দরের বাইরে অস্থায়ী কুরিয়ার হাব স্থাপন করা দরকার। ডিজিটাল ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামো হালনাগাদ করা আবশ্যক। এই পদক্ষেপগুলো জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া দ্রুত পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি সুরক্ষিত ও অগ্নিনিরোধক অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা উৎপাদন ও রফতানিতে বিপর্যয় না ঘটায়।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুন শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি বাংলাদেশের রফতানি অবকাঠামোর দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। তৈরী পোশাক খাত, যা দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে, তার উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো একটি মাত্র অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। যত দ্রুত সম্ভব কুরিয়ার পণ্য উদ্ধার ও বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে, দেশের রফতানি প্রবাহে বড় ধাক্কা লাগবে। সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ করলে শুধুমাত্র এই সঙ্কট নয়, ভবিষ্যতের লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পথও সুগম হবে আর তাতেই পুনরায় প্রাণ ফিরে পাবে বাংলাদেশের রফতানিমুখী শিল্প।