গ্রাহককে ঋণ অবলোপনের ১০ দিন আগে জানাতে হবে

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের ১০ দিন আগে গ্রাহককে জানানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে যা ছিল ৩০ দিন। গতকাল বুধবার এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক সার্কুলার জারি করা হয়েছে। নতুন এ নির্দেশনা সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অবিলম্বে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এর আগে ১৯ অক্টোবরের সার্কুলারে অবলোপন প্রক্রিয়া শুরুর ৩০ দিন পূর্বে গ্রাহককে জানানো বাধ্যতামূলক ছিল। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, সময়সীমা ৩০ দিন থেকে ১০ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা মতে, একটি কেইস সেটেল করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ার কারণে অবলোপন প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকর ও দ্রুততর করতে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো যেন ঋণের শ্রেণীকরণ, প্রভিশনিং এবং রাইট-অফ সংক্রান্ত কাজগুলো সময়মতো সম্পন্ন করতে পারে, সেজন্য কম সময়ের নোটিশ কার্যকর হবে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, কোনো ঋণ একাধারে মন্দ এবং ক্ষতিজনক মানে অবস্থান করলে তা অবলোপনের যোগ্য ধরা হবে। বিশেষ করে অধিক পুরনো শ্রেণীকৃত ঋণগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অবলোপন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে অবলোপন হলেও ঋণগ্রহীতা সম্পূর্ণ দায় পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত রাখা হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে এবং ব্যাংকগুলো ব্যালান্সশিট থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ সরিয়ে নিতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ব্যাংকিং খাতে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। অন্য দিকে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশের মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে তিন লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা মন্দ ও ক্ষতিজনক শ্রেণীতে রয়েছে, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮১.৩৭ শতাংশ। এটি ইঙ্গিত করে যে উল্লেখযোগ্য অংশের ঋণ বাস্তবে আদায়যোগ্য নয়, ফলে রাইট-অফ প্রক্রিয়া ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীকে বাস্তবসম্মত করতে সহায়ক হতে পারে।

নতুন সার্কুলারে আরো বলা হয়েছে, অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নগদ প্রণোদনা দিতে পারবে। কোনো ব্যাংকের এ ধরনের নীতিমালা না থাকলে তা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে প্রণয়ন করতে হবে। এর মাধ্যমে রাইট-অফ ঋণ পুনরুদ্ধারে কর্মকর্তাদের উৎসাহ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো, ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন বা সংরক্ষণ তহবিল রাখতে হবে। কোনো ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রভিশনে ঘাটতি থাকলে তা চলতি বছরের ইনকাম অ্যাকাউন্ট থেকে সমন্বয় করে পূরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থান স্বচ্ছ হবে, পাশাপাশি অনাদায়ী ঋণের চাপ হিসাবপত্রে কম প্রতিফলিত হবে।

সার্বিকভাবে, নতুন নির্দেশনা ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিটে অবলোপন প্রক্রিয়া দ্রুততর করবে, যদিও খেলাপি ঋণ সঙ্কট সমাধানের মূল চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। এই নীতিমালা স্বল্পমেয়াদে হিসাবপত্র পরিষ্কার করলেও দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পুনরুদ্ধার সক্ষমতা ও সুশাসন নিশ্চিত করাই হবে মূল লক্ষ্য।

আন্তর্জাতিক কার্ডে বিমানভাড়া পরিশোধে বাধা দূর হলো : বাংলাদেশে বসে আন্তর্জাতিক ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে বিদেশে রুটের বিমান টিকিট কেনার সুযোগ উন্মুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণকারীদের দাবি ও ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে যে জটিলতা বজায় ছিল, তা দূর করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে টিকিট সিন্ডিকেটের অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। গতকাল বুধবার অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোকে পাঠানো এক সার্কুলারে আন্তর্জাতিক কার্ডে সরাসরি টিকিট কেনার অনুমতি দেয়া হয়।

এর আগে আন্তর্জাতিক কার্ড শুধুমাত্র বিদেশে অবস্থানকালে ব্যয়ের জন্য ব্যবহারের অনুমতি ছিল। ফলে দেশে বসে বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের পছন্দমতো মূল্য বা প্রতিযোগিতামূলক ভাড়ায় টিকিট কিনতে পারতেন না। অনেক সময় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আন্তর্জাতিক মূল্যের তুলনায় বেশি দাম পরিশোধ করতে হতো কিংবা বিকল্প ডিজিটাল পেমেন্ট সুবিধা না থাকায় সীমিত চ্যানেলের ওপর নির্ভর করতে হতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ডিজিটাল পেমেন্টের কাঠামো সম্পূর্ণ উন্নত না থাকায় গ্রাহকরা বৈধপ্রক্রিয়ায় টিকিট কিনতে গিয়ে ভোগান্তির সম্মুখীন হতেন। এই প্রেক্ষাপটে বাজারে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে এবং গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় নীতিমালাটি হালনাগাদ করা হয়েছে।

নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশের যেকোনো বৈধ ভিসাধারী যাত্রী এখন থেকে দেশে কার্যরত এয়ারলাইনসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহার করে সহজেই টিকিট কিনতে পারবেন। এতে গ্রাহকের সুবিধা বাড়বে, একই সাথে টিকিট বিক্রির অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে থেকে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহের ওপরে নজরদারি আরো শক্তিশালী হবে। সার্কুলারে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, টিকিট বিক্রির সম্পূর্ণ অর্থ অবশ্যই এডি ব্যাংকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে এবং এই অর্থ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হিসেবেই গণ্য হবে।

নতুন নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, ভ্রমণ কোটার আওতায় ইস্যু করা কার্ডে টিকিটের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তা আবার কার্ডে জমা বা রিফিল করার সুযোগ দেয়া হবে। তবে রিফিল কেবল তখনই করা যাবে যখন এডি ব্যাংক নিশ্চিত হবে যে টিকিট বিক্রির অর্থ যথাযথভাবে স্থানীয় ব্যাংকিং চ্যানেলে জমা হয়েছে। এতে অনিয়ম বা অর্থপাচারের সুযোগ কমবে এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

এয়ারলাইনসগুলোর জন্যও এসেছে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এডি ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে, যেখানে টিকিট বিক্রির আয় জমা রাখা যাবে। প্রচলিত নিয়মে এই হিসাবের উদ্বৃত্ত অর্থ টাকায় রূপান্তর না করেই বিদেশে পাঠানো যাবে। ফলে এয়ারলাইনসগুলোর আর্থিক লেনদেন আরো দ্রুত ও স্বচ্ছ হবে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতকে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল পেমেন্ট মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে। এতে টিকিটিং প্রক্রিয়া আরো সহজ, ঝামেলাহীন ও প্রতিযোগিতামূলক হবে। একই রুটের ভাড়ার যে বৈষম্য আগে দেশী-বিদেশী চ্যানেলের মধ্যে দেখা যেত, তা কমে আসবে। গ্রাহক অনায়াসে আন্তর্জাতিক মানের অনলাইন সেলস চ্যানেল ব্যবহার করতে পারবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নিয়ন্ত্রণও আরো শক্ত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগকে অনেকে যুগোপযোগী ও গ্রাহকবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। বৈশ্বিক ভ্রমণপ্রবাহ এবং ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে নেয়া এই সিদ্ধান্ত বিমানভাড়া পরিশোধের প্রক্রিয়াকে আরো আধুনিক, নিরাপদ এবং স্বচ্ছ করে তুলবে বলে আশা করা হচ্ছে।