অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শেষে ঢাকায় ফেরার দিন এক ভয়ঙ্কর নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলটির ‘স্লিপারসেল’ বা আত্মঘাতী সদস্যদেরও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। ঢাকার বাইরের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীও প্রস্তুত ছিল। এমনকি ঢাকা ঘিরে প্রায় ১০ লাখ লোকের সমাগমেরও পরিকল্পনা ছিল দলটির। এই পরিকল্পনায় কয়েকজন আইনজীবীরও সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে গোয়েন্দারা। সরাসরি মিছিল এবং আবাসিক হোটেল ও ফ্ল্যাট বাসায় বসে প্রতিনিয়ত ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন তারা। তবে পুলিশ ও র্যাবের তৎপরতায় বিপাকে পড়েছে সংঘবদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গত শনিবার দৈনিক নয়া দিগন্তে ‘আ’লীগের স্লিপারসেল গঠন’ প্রধান শিরোনামে এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর থেকেই নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গোয়েন্দা তদন্তে দলটির যে পরিকল্পনা ছিল তা মাঠপর্যায়ে পাওয়ার পর গত বুধবার পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা একের পর এক অভিযান চালিয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ২৪৪ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কয়েকজন আইনজীবীও রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তাদের পরিকল্পনা ছিল বড় শো-ডাউনের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টাকে বিমানবন্দরে অবরুদ্ধ করে আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তায় ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার।
এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশবিরোধী এবং রাষ্ট্রের ক্ষতির জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুত থাকায় তাদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে আমাদের গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী নিষিদ্ধ দলের নেতাকর্মীরা দুর্গাপূজায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। সেই আশঙ্কা মাথায় রেখে প্রশাসন কাজ করছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে প্রায় দেড় হাজার মানুষ হত্যার অভিযোগ কাঁধে নিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। নেতা-কর্মীরা এতদিন ঘাপটি মেরে থাকলেও এখন আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন। টার্গেট করতে থাকেন অনলাইনে-অফলাইনে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশে বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, তেজগাঁও, শাহাবাগ, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মাদপুর, ওয়ারী, মতিঝিল, গুলশানসহ বেশ কিছু এলাকায় তারা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। জানা যায়, গত এক সপ্তাহে সারা দেশ থেকে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল থেকে প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো: নজরুল ইসলাম জানান, গত বুধবার আটক নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ১৪টি ককটেল এবং ৬০টি ব্যানার উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আবাসিক হোটেল, ফ্ল্যাট ও ছাত্রাবাসে লুকিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীদের সন্ধান চেয়ে সাধারণ মানুষের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। যারা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা সংগঠনটির কর্মীদের তথ্য দেবেন, তাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। নজরুল ইসলাম বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যেসব ঝটিকা মিছিল বের করছে। এসব মিছিল পণ্ড ও তাদের ধরতে আমরা তৎপর। এসব কাজেও জনসাধারণ পুলিশকে সহায়তাও করেছে। তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্টের চেষ্টা করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নানা ইস্যুতে শুরু হয়েছে অস্থিরতা ও সহিংসতা। নির্বাচনের আগেই দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চক্রান্ত চলছে। নির্বাচন বানচাল ও পরবর্তী নির্বাচনের অংশগ্রহণের জন্য সহিংসতা, অস্থিরতা ও অরাজকতায় নিষিদ্ধ পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, নিষিদ্ধ দলের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি কয়েকটি মিছিলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আইন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ঢাকায় ঝটিকা মিছিলকেন্দ্রিক নেতাকর্মীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ইউনিফর্ম পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশও কার্যক্রম চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকার কয়েকজন নেতৃত্ব দিলেও বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী ঢাকার বাইরে থেকে আসছে, যাতে তাদের সহজে শনাক্ত করা না যায়। যেমন- ধানমন্ডির মিছিলটি করেছেন চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা, আর তেজগাঁওয়ের মিছিল করেছে বাগেরহাট ও খুলনার একটি গ্রুপ। এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের। তবে মিছিলগুলো অর্গানাইজ করছেন ঢাকা মহানগরের নেতারাই। আমাদের সজাগ, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত।’