হাসান মাহমুদ রিপন
এখন বাতাসে ছাতিমের ম ম সুবাস। প্রকৃতিতে বয়ে বেড়ানো হালকা বাতাসের সাথে থেকে থেকে ভেসে আসে বুনো ফুল ছাতিমের মিষ্টি ঘ্রাণ। বিকেলের সূর্য যখন গোধূলিতে তখন থেকেই যেন একটু একটু করে ছড়াতে থাকে মায়াবী এ ঘ্রাণ। এ মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় বাতাসে ছাতিমের গন্ধ। ছাতিম ফুলের সুবাসে মুগ্ধ হয় পথচারী। সাদা ফুলে পুরো গাছ ঢেকে থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকেই রাতের পুরো সময়টায় এ গাছের ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে ফুলের ম ম গন্ধে সুবাসিত হয়ে যায়। ঝাঁকড়া পত্রপল্লব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু এই গাছের শাখা প্রশাখায় ভরা পাতা আর সাদার মধ্যে সবুজাভ রঙে থোকায় থোকায় অগুনতি ফুলে প্রকৃতির কি নিসর্গ তা না দেখলে অনুভব করা যায় না।
ছাতিমগাছ যেন শিশি উপুড় করে সন্ধ্যার বাতাসে গন্ধ ঢেলে দেয়। রাত বাড়ার সাথে সাথে তীব্র ও মাদকতাময় হয়ে ওঠে এই গন্ধ। দেখা যায় সারা গাছ ছেয়ে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ফুল। ছাতিম গাছের ডালের গঠন ও পাতার বিন্যাস এতই সুন্দর যে পথ চলতে যে কেউ মুগ্ধ হবে। আর এর ফুলের তীব্র গন্ধ অনেক দূর থেকেই পথিককে কাছে টানবে। কাণ্ডগুলো ছাতার মতো বেষ্টিত হয়ে থাকে। হয়তো এ কারণেও গাছটির নাম ছাতিম। ছাতিম গাছ প্রায় ৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। চিরসবুজ দুধকষভরা সুশ্রী গাছ। পাতা প্রায় ১৮ সেমি লম্বা, মসৃণ, উপর উজ্জ্বল সবুজ, নিচ সাদাটে। শরতের শেষে সারা গাছ ভরে গুচ্ছবদ্ধ, তীব্রগন্ধী, সবুজ-সাদা ছোট ছোট ফুল ফোটে। ফল সজোড়, থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে। এর আদি আবাস ভারত, চীন ও মালয়েশিয়া। macrophylla জাতের ছোট ছাতিম বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জন্মে। ফুল সাদা ও আকারে কিছুটা বড়।
এ গাছের সংস্কৃত নাম সপ্তপর্ণী। অঞ্চলভেদে একে ছাতিয়ান, ছাইত্যানসহ নানা নামে ডাকা হয়। ছাতিম ঘিরে অনেক মিথও রয়েছে। এ গাছে নাকি ভূত থাকে তাই শয়তানের গাছও বলে। পশ্চিমা বিশ্বেও আছে ছাতিমের বদনাম, ইংরেজিতে ডাকা হয় ‘ডেভিলস ট্রি’। বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia Scholaris। স্কলারিস শব্দটির সাথে বিদ্যা অর্থাৎ লেখাপড়ার যোগ আছে। এ ধরনের নামকরণের কারণ, ছাতিমের নরম কাঠ থেকে ব্ল্যাকবোর্ড ও পেনসিল তৈরি হয়। এ ছাড়া প্যাকিং বাক্স তৈরির জন্যও এটির কাঠ ব্যবহার করা হয়। এর ফুল ফোটার মৌসুম শরৎ-হেমন্ত কালে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ফুলের মধ্যে এই ফুল অন্যতম। তাই শান্তিনিকেতনে অজস্র ছাতিম ফুলের গাছ আছে।
বাংলাদেশে এক সময় গ্রামের রাস্তার পাশে, বনে-জঙ্গলে অহরহ এ গাছ থাকলেও বর্তমানে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। দূর থেকে ভেসে আসা সুঘ্রাণ শুঁকে গাছটিকে খুঁজে নিতে হয়। নির্বিচারে গাছ কেটে বিক্রি করা বা বসতবাড়ি নির্মাণের ফলে অন্যান্য গাছের সাথে উজাড় হতে হতে এখন এ ছাতিম গাছের দেখা মেলে না বললেই চলে। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ছাতিম গাছ এখন বিপন্ন প্রজাতির হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি জায়গায় ছাতিম গাছ দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ঢাকার অফিসার্স ক্লাব, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, শহীদ মিনার, কার্জন হল, আব্দুল গণি রোড, নিকেতন (পুলিশ প্লাজার বিপরীতে), হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত, নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল গেটের রাস্তার ওপার, সোনারগাঁওয়ের মোগড়াপাড়া কাবিলগঞ্জসহ নানা জায়গায় এখন ছাতিমের শোভা-সুরভি উপভোগ করা যাবে।
সোনারগাঁওয়ে মোগড়াপাড়া এলাকার রফিকুল হায়দার জানান, ছাতিম গাছ এক সময় এই এলাকায় অনেক ছিল। পুরো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দু-পাশজুড়ে বিভিন্ন স্থানেই ছাতিম গাছের দেখা পাওয়া যেত। সারা বছর এই গাছের কথা মনে না থাকলেও শরত ও হেমন্ত এলেই ছাতিম ফুল নিজেই তার সুগন্ধে অস্তিত্ব জানান দেয়। বড় বড় গাছ সাদা ফুলে ঢেকে যায়। তবে আজকাল তেমন একটা দেখা যায় না। মোগড়াপাড়া কাবিলগঞ্জ, চৌরাস্তার বাড়িচিনিষ, দড়িকান্দি এলাকায় ছোট বড় কয়েকটি গাছ দেখা যায়। এই গাছের ফুলের ঘ্রাণে পুরো এক থেকে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত ছেয়ে যায়। তবে হয়তো এক সময় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না অপূর্ব সুন্দর ফুলের সুগন্ধের এই গাছটি। সোনারগাঁওয়ের কয়েকটি নার্সারির মালিক জানান, নার্সারিগুলোতে ছাতিম গাছের চারা কম পাওয়া যায়। কেননা এই গাছের চারা তেমন একটা বিক্রি হয় না।



