জুলাই সনদের স্বীকৃতি প্রশ্নে আড়ালেই চলছিল রাজনৈতিক টানাপড়েন। এখন তা প্রকাশ্য সঙ্কটে রূপ নিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, আড়ালের চোরাগোপ্তা আগ্রাসন, দেরিতে নেয়া সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ হিসাব-নিকাশ পুরো প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন ইস্যুতে হাসিনাকে পুনর্বাসনের প্রকল্পে টেনে আনতে ভারত শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ। জুলাই আন্দোলনের রক্তের স্মৃতি তখনো টাটকা থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সংবিধানকে সামনে এনে আগের অবস্থানে ফিরতে পারেনি। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে নির্বাচনের বয়ান পদ্ধতিগতভাবে টকশো ও মিডিয়ায় তৈরি হয়েছেÑ ‘ক্ষমতায় যেতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান’।
অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না। তবে মামলার রায়ের আগেই সারা দেশে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুনের ঘটনা বাড়ছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সাম্প্রতিক মন্তব্য ক্ষমতার টানাপড়েনকে আরো স্পষ্ট করছে।
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কাটছে না : দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে নয়া দিগন্তকে আইনজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ বলেছেন, রাজনীতিবিদরা ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলো। চাপিয়ে দেয়ার মতো একটা সিদ্ধান্ত। বিএনপি থেকে একটি, জামায়াত থেকে একটি ও এনসিপি থেকে একটি। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বলা যায় যে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতা যদি না হয় তাহলে তো নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখি না।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে তামাশা হয়েছে। সময় ক্ষেপণ করে মাসের পর মাস রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনা করেছে। প্রথমেই গণভোট করা যেতÑ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথমে খুনের বিচার, তারপর সংস্কার ও নির্বাচন চান কী না। আমার বিশ্বাস তাতে এত জটিলতা সৃষ্টি হতো না। ‘হ্যাঁ’ বিপুল ভোটে জিতত। এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিকে আর যেন কিছু দেয়ার নেই। যে রাজনৈতিক দলটি মনে করছে নির্বাচন হলেই ক্ষমতায় যাবে তারা চান অন্তত নির্বাচন পর্যন্ত ইউনূস সাহেব থাকুক। আর যারা ফ্যাসিস্ট শক্তি হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে, যারা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার বানচাল করার অপচেষ্টা করছে। তারা চান জটিলতা আরো বাড়ুক। জুলাই আন্দোলনে খুনিদের বিচার যারা চায় না তারা চায় ইউনূস সাহেব চলে গেলেই বাঁচি।
তার মানে পরিস্থিতি এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে নির্বাচনের পক্ষে বিপক্ষে শক্তিশালী দুটো পক্ষ কাজ করছে। আবু হেনা রাজ্জাকী মনে করেন ঠিক তাই। নির্বাচনে বিজয় সুনিশ্চিত যারা মনে করছেন তারা চান ইউনূস থাকুক। আর জুলাই আন্দোলনের আইনি ভিত্তি তো দূরের কথা, গণভোট বা নির্বাচন না হোক যারা চান তারা ক্রমান্বয়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে, প্রকাশ্যে তোড়জোড় শুরু করেছে।
সাধারণ মানুষ যদি নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফিরে না পায় রাজনৈতিক দলগুলো কি রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ক্যাশ করতে পারবে বা ফায়দা তুলতে পারবে? ইকতেদার আহমেদ মনে করেন, না এখন তো নির্বাচনের দিন গণভোট খুবই ডিফিকাল্ট টাস্ক। ভোটারের কাছে চার প্রশ্ন। চারটাতে হ্যাঁ বলতে হবে। একটাতে হ্যাঁ আরেকটাতে না বলার সুযোগ নাই। চারটাতে হ্যাঁ অথবা না বলতে হবে। একই দিন গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তারপর জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি বা আইনি ভিত্তি। সংবিধানের অধীনে শপথ নেয়া এ সরকার এখন বলছে যে জনআকাক্সক্ষার বাস্তবায়নে জুলাই আদেশটা করেছে। এটাও তো সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলনে প্রথমে সরকারটাই জনআকাক্সক্ষার করা উচিত ছিল। এখন যে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলনে জুলাই সনদ করল এটা তো সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এ রকম অনেক ধরনের জটিলতা আছে।
জুলাই আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ শুরু : এতকিছুর পরও আবু হেনা রাজ্জাকী মনে করেন কার্যত বাংলাদেশ জুলাই আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো স্বৈরাচারকে সতেরো বছর কিছুই করতে পারেনি। বেগম জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো, তারপর তার ভাড়া ভাড়ির সামনে বালুর ট্রাক সরাতে পারেনি। বেগম জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারেননি, অনেক রাজনৈতিক নেতাকে দেখেছি সর্দি কাশির জন্য ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরে যেতে। সেই বেগম জিয়া যখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য গেলেন সম্মানের সাথে যেতে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু তার পাটাতন গড়ে দিয়েছিল বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ছাত্র-জনতা। তো এখন যদি নির্বাচন হয় তাও সাসটেইনবল হবে কি না সংশয় রয়েছে। টার্নিং পয়েন্ট আছে অনেক। আগামী ১৭ নভেম্বর রায়, কাস্টডিতে থাকা কিছু আর্মির ট্রায়াল চলছে, সারা দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলা হচ্ছে। এর আড়ালে অনেক ইন্ধন রয়েছে। কাগজে-কলমে রাজনৈতিক দলগুলো গণভোট নিয়ে দৌড়াচ্ছে, সারফেসে এক রকম দেখা গেলেও এর নিচে অনেক কিছু চোখের আড়ালে থেকে যায়। ইনফ্যাক্ট কি হচ্ছে তার অনেক কিছু জানা যায় না। এটুকু জানি হাসিনার মতো ফ্যাসিস্টের পরাজয় ও দেশ ছেড়ে পালানো ছিল প্রথম বিজয়। দেশটা হয়তো আলটিমেটলি একটা অবস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে, সেই পর্যায়ে আমরা ঢুকছি বলে মনে হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলের স্বার্থে তরুণদের ত্যাগ উপেক্ষিত : বারবার কি তরুণরা রাজপথে নেমে আসবে রাজনৈতিক দল বা আর কারো দায় নেই? আবু হেনা রাজ্জাকী এ প্রসঙ্গে বলেন, খেয়াল করুণ তরুণরা বারবার জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া, গণভোট ছাড়া নির্বাচন হবে না বললেও তাদের এ ফিরে আসাকে হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে। এর সহজ কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্যÑ ক্ষমতা। নির্বাচন বা যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা পাওয়া। ৫ আগস্ট যে সংবিধানটা ছিল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটা নিয়ে বসে যাবে। শুধু শুধু গত ১৫ মাস ধরে সংস্কার প্রস্তাবের আড়ালে সবাই বলল ইউনূসকে সহযোগিতা করছে। সেটিই যদি হবে তাহলে, এখনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল থাকে কিভাবে। এই রাজনৈতিক দলগুলোই জুলাই আন্দোলনের স্টেকহোল্ডার দাবি করে। কিন্তু সংস্কার ও গণভোটে তাদের সাংঘাতিক অরুচি ও উষ্মা। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি আর কারো মাথায় নাই। এমনকি সিট ভাগাভাগির কথা শুনতে পাই। আঁতাতের কথা শুনতে পাই। নিশ্চিত থাকেন একসময়ে গণভোটেরও কোনো গুরুত্ব থাকবে না। অথচ স্বৈরাচারের দীর্ঘ সতেরো বছর এরাই গুম, খুনের শিকার হয়েছে। একসাথে মার খেয়েছে। আয়নাঘরে যেতে হয়েছে। সিনহা হত্যা, শাপলা চত্বর ও পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ ৮৫ শতাংশ রাজনীতিবিদদের ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকেন। ফেরিওয়ালা, খেটে খাওয়া মানুষ, বাদাম কিংবা সবজি বিক্রেতা, কৃষকের সন্তান তাদের সেøাগান দিয়ে, বিরানি খাইয়ে, ৫০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে রাজপথে পাঠিয়েছে। তাদের ডেডবডিগুলো কাউন্ট হয়, রাজনৈতিকভাবে ক্যাশ করা হয়, নিজের বাপ মারা গেলে দুপুরে না খেলেও মানুষকে রাতে ঠিকই খেতে হয়। তো আমজনতা মারা গেলে রাজনীতিবিদদের কি আসে যায়।
কিন্তু প্রতিবাদ তো নিস্তব্ধ হয়ে যায়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে ইকতেদার আহমেদ বলেন, জামায়াত কর্মসূচি দিচ্ছে। নির্বাচন হবে কি না এখনো বলা খুব ডিফিকাল্ট। ২৫টা রাজনৈতিক দলের সাথে সরকার আলাপ আলোচনা করেছে, দল আছে ৪০-৪৫টা। পরবর্তীতে তিনটি রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে সরকার এসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। বাকি ২২টি রাজনৈতিক দল নিয়ে ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা এখনো পশ্চিমারা বলছে, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা হলে সেটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য যদি না হয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পায় তাহলে তো সঙ্কট দেখা দেবে।
রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের বাস্তবতা : ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা তো প্রথম ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল হাসিনাকে পুনর্বাসন করার জন্য? ইকতেদার আহমেদ বলেন, এখন আমেরিকাও তো প্রায় একই কথা বলছে। জাতিসঙ্ঘ বলছে। যেখানে যার খুনের বিচার হচ্ছে তাকে যদি নির্বাচনে নিয়ে আসেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হয়তো অন্য নামে আসবে। জাতীয় পার্টির নামে? তাদের যদি নির্বাচনের বাইরে রাখেন এটা তো একটা কেমন, তারা এত বছর দেশ শাসন করেছে। তাদের যদি ২০ শতাংশ ভোট থাকে।
কিন্তু রেস্ট অব দেম যারা একেবারে রাজপথে নেমেছে তারা যদি কোনো প্রাপ্তি না পায় তাদের রক্তের ওপর দিয়ে, তারা তো বারবার রাস্তায় নেমে আসবে না। আমরা তো রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখেছি, তারা ১৬-১৭ বছর স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পারেনি, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এখন স্টেকহোল্ডার মনে করছে রাজনৈতিক দলগুলো। এত কিন্তু বা প্রশ্ন এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক জটিলতাই বাড়িয়ে দেবে অনেকের ধারণা।
সমাধান কোথায়?
ইকতেদার আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরিবর্তনের পর তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে অবস্থান পরিবর্তন করেছে কি না প্রশ্ন আছে, আসলে তো বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল। সমাধান কি? রাজপথ না গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণযোগ্য মীমাংসায় পৌঁছাতে পারবে। ইকতেদার আহমদ বলেন, রাজপথে তো কখনো সমাধান হয় না, রাজপথে দাবি দাওয়া আন্দোলন হয়, রাজপথে দাবি দাওয়া যত শক্তিশালী হবে এটার সমাধান তত গতি পাবে, সবার করণীয় তাহলে কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা মেনে নেয়া, তা যদি মেনে না নেয়া হয় তাহলে সঙ্ঘাত অনিবার্য।



