অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে অর্থনীতির বড় বিপর্যয় ঠেকানো গেছে : সিপিডি

হঠাৎ করে কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বে না : বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর

Printed Edition
রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডির আলোচনা সভায় অতিথিরা : নয়া দিগন্ত
রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডির আলোচনা সভায় অতিথিরা : নয়া দিগন্ত

বিশেষ সংবাদদাতা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও সংস্কারের ফলে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। বেসরকারি এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে যার মধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কার অন্যতম। এর ফলে রেমিট্যান্স ও রফতানি বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটা ভালো অবস্থায় গেছে। পতন ঠেকিয়ে একটা বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করা গেছে। এটি একটি অন্যতম সাফল্য। এর পাশাপাশি এটিও জানি মূল্যস্ফীতি উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগ আসছে না, কর্মসংস্থান হচ্ছে না। রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। সুতরাং এই বিষয়গুলো আগামী ৬ মাস নতুন সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।

গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক ‘সিপিডি ডায়ালগে’ এমন মন্তব্য করেন তিনি।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরসহ বিভিন্ন দলের নেতা ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক খাতে কেবল স্থিতিশীলতা এসেছে। রাজনৈতিক খাতে তো আসেনি। সিকিউরিটি সিচ্যুয়েশন তো এখনও আনস্টেবল। সব কিছু মিলিয়ে এখনই কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই প্রত্যাশা যদি কারো থাকে, আমি বলবো সেটা কাল্পনিক। আমাকে বাস্তবসম্মত হতে হবে।

বিনিয়োগ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, আমরা পাইপলাইনে বিনিয়োগ দেখতে পারছি। এটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু আরেকটু সময় লাগবে। সামনে নির্বাচন, এই মুহূর্তে হয়তো বড় কোনো বিনিয়োগকারী আসতে চাইবে না। বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আসতে চাইবে না; কারণ পরবর্তী সরকার যদি সব চেঞ্জ করে ফেলে। এটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

তিনি বলেন, ‘৫ বিলিয়ন ডলার করে পণ্য আমদানি করছি। তাতে কি আমদানি কম হচ্ছে। বাজারে কি কোনো পণ্যের অভাব আছে। হয়তো বলতে পারেন ক্যাপিটাল মেশিনারি ইমপোর্ট করছি না। যৌক্তিক কথা কিন্তু এখন এখানে কে বিনিয়োগ করবে? আমরা খাদের কিনারায় ছিলাম সেখান থেকে যদি দ্রুত ফেরত আসতে না পারি তা হলে খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা অনেক বেশি, যোগ করেন গভর্নর।

তিনি ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, এতে করে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ বেঁচে যাবে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন শাসনভার গ্রহণ করলেন গত বছরের ৮ আগস্ট, তার এক সপ্তাহ পর ১৪ আগস্ট আমরা একটা আলোচনা করেছিলাম যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী? তখন আমাদের অর্থনীতি বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন হচ্ছিল। টাকার বিনিময় হারের অবনমন হচ্ছিল খুব দ্রুত। সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়ছিল, রফতানি প্রবৃদ্ধি কমছিল। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট সিপিডির পক্ষ থেকে এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলি। এখন এক বছর পর যখন ফিরে তাকাচ্ছি তখন মূল্যায়নের একটা সময় এসেছে, প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, নাজুক পরিস্থিতি থেকে ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যাওয়ার চেষ্টায় আছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ মোটামুটি ঘোষণা হয়েছে। যত আলোচনা বা সমালোচনা করি না কেন, গোষ্ঠীগতভাবে রাজনীতিবিদরা আমাদের আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নগুলো ধারণ করেন।

মানিলন্ডারিং বন্ধ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি : সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়া। অর্থনীতি স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে এই সময় অনেক কাজ হয়েছে। বড় বিষয় হচ্ছে মানিলন্ডারিং বন্ধ হয়ে গেছে। যারা লন্ডারিং করতো তারা তো পালিয়ে গেছে। যারা দেশে আছে তাদের হাতে টাকা নেই। মানিলন্ডারিং বন্ধ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। রফতানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের উচিত ছিল স্বৈরাচারের বাজেট চালিয়ে না যাওয়া। ওই বাজেট বাদ দিয়ে সামাজিক বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে নতুন বাজেট দিতে পারতাম। আমি মনে করি এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল কিছু দেখতে পাইনি : বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) বর্তমান সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গভর্নর বলে গেলেন বিপদের সময় জনশক্তি ও গার্মেন্টস খাত তাদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন গত ৩৬৫ দিনে আমাদের জন্য কী করেছেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে টেক্সটাইল খাতে করপোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। ফিনিশড প্রোডাক্ট আসবে শুল্ক ছাড়া কিন্তু কাঁচামাল তুলা ২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তার ওপর চাঁদাবাজ তো আছেই। গ্যাস ও বিদ্যুৎ নেই। গত ৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল আমি কিছু দেখতে পাইনি। আমি গঠনমূলক সমালোচনা করছি, এটাকে তিরস্কার ভাববেন না।

ব্যাংক লুটপাট প্রসঙ্গে রাসেল বলেন, লুটপাটে যে ব্যাংক নষ্ট হয়ে গেছে, তাকে আবার কেন টাকা দিচ্ছেন? আপনি গ্রাহককে টাকা দিয়ে ওই ব্যাংক বন্ধ করে দেন। চোরগুলোকে কেন টাকা দিচ্ছেন, চোরের মালিকানা কিন্তু কখনোই নষ্ট হবে না। আবার ছোবল মারবে। ওই ব্যাংক বন্ধ করে ভালো ব্যাংকের শাখা বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থান ঠিক রাখতে পারেন। তাতে সবাই খুশি হবে। ছোট একটি দেশে এতগুলো ব্যাংক সত্যিই অবাক করার মতো। বাংলাদেশের মতো পরিবারিকভাবে ব্যাংক কোথাও দেয়া হয় না।