দখল ভরাটে কীর্তিনাশার শাখা নদী ময়লার স্তূপ

প্রভাবশালী মহলের জরিপ জালিয়াতির মাধ্যমে দখল ও ভরাটের কবলে পড়ে নদী হারাচ্ছে নাব্যতা। কৃষিতেও পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব। এরই ধারাবাহিকতায় পদ্মার শাখা নদী কীর্তিনাশার প্রায় ১২ কিলোমিটার শাখা নদীটি এখন মৃতপ্রায়।

মো: বোরহান উদ্দিন রব্বানী, শরীয়তপুর
Printed Edition
কীর্তিনাশার শাখা নদীটি সরু হয়ে এই রূপ ধারণ করেছে
কীর্তিনাশার শাখা নদীটি সরু হয়ে এই রূপ ধারণ করেছে |নয়া দিগন্ত

পদ্মা, মেঘনা ও আড়িয়ালখাঁ বেষ্টিত পলিযুক্ত উর্বরা মাটির সম্ভাবনার জেলা শরীয়তপুর। কৃষিনির্ভর অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল নদীগুলো। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের জরিপ জালিয়াতির মাধ্যমে দখল ও ভরাটের কবলে পড়ে নদী হারাচ্ছে নাব্যতা। কৃষিতেও পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব। এরই ধারাবাহিকতায় পদ্মার শাখা নদী কীর্তিনাশার প্রায় ১২ কিলোমিটার শাখা নদীটি এখন মৃতপ্রায়।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ও সরেজমিনে দেখা গেছে, শাখা নদীটি জেলা সদরের রাজগঞ্জ আড়িগাঁও বাজার থেকে উৎপন্ন হয়ে আঙ্গারিয়া এলাকায় গিয়ে মূল নদীর সঙ্গে মিলেছে। দুই দশক আগে বর্ষা এবং শুষ্ক মৌসুমেও ছিল পানিপ্রবাহ। এর কারণে আশপাশের উর্বর কৃষিজমিতে ছিল ফলন এবং দেশী প্রজাতির মাছের সমাহারে পরিপূর্ণ ছিল নদী। নদীপাড়ের অনেক পরিবারের আয়ের উৎস ছিল মাছ ধরা। সময়ের সাথে সাথে সেই নদীতে এখন কচুরিপানা, কাশবন ও আগাছার দৌরাত্ম্য। ফলে কমেছে কৃষি সেচের সুযোগ। মৎসজীবীরাও হারিয়েছে পেশা। তাই নদীটির প্রবাহ ধারা ফিরিয়ে আনতে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে নদী পরিব্রাজক দল শরীয়তপুরের মানববন্ধনে যোগ দিয়েছে স্থানীয়রাও। দাবি কেবল নদীর প্রবাহমানতা ফিরিয়ে আনা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও স্থানীয়দের আবেদনের প্রেক্ষিতে নদী পুনঃখননের মাধ্যমে আবার প্রবহমান করার প্রক্রিয়া আমরা হাতে নিতে পারি।

সদর উপজেলার চিকন্দি ইউনিয়নের আবুরা গ্রামের হাজী সোহরাব হোসেন খান (৯০) বলেন, ছোট বেলায় এই নদী দিয়ে আমরা লঞ্চে যাতায়াত করতাম। জেলেদের জালে ধরা পড়ত পদ্মার ইলিশ। পলিমাটিতে ফলত সোনার ফসল। এখন এ সবই দুঃস্বপ্ন। এখন বর্ষায় দেখি কচুরিপানার ভিট, আর শুকনো মৌসুমে কচুরিপানার সাথে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। এই অঞ্চলে এখন নেই কোনো নৌকার চিহ্ন। নদীটিকে যদি খনন করে আবার প্রবহমান করা যায়, তবে লঞ্চ চলাচল না করলেও দেখা মিলবে বাহারি নৌকার, পাওয়া যাবে মাছ, বাড়বে কৃষি উৎপাদন।

চিকন্দি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সঙ্ঘের সভাপতি কবি জিহান রব্বানী জাকির বলেন, কীর্তিনাশার এই শাখা নদীটি রাজগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে আঙ্গারিয়া এলাকায় মূল কীর্তিনাশার সাথে মিলেছে। এক সময় এই নদীতে বর্ষায় ইলিশ পাওয়া যেতো। শুকনো মৌসুমেও ছিল পানি প্রবাহ। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে সাথে প্রভাবশালীদের দখল ও ভরাটের কারনে নদীটির শাখামুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ভরা বর্ষায়ও নদী থাকে কচুরিপানার দখলে। এতে করে যেমন কৃষিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তেমনি স্থানীয় প্রজাতির মাছও বিলীন হওয়ার পথে। আশপাশের ক্ষুদ্র মৎসজীবীরা হারিয়েছে পেশা। নদীটিকে পুনঃপ্রবহমান করা গেলে যেমন কৃষি সমৃদ্ধ হবে তেমনি স্থানীয় প্রজাতির মাছের সমাহারেও যুক্ত হবে নতুন নতুন মাছ।

শরীয়তপুর জজকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোদাচ্ছের হোসেন বাবুল বলেন, সিএস আরএস নকশায় যেখানে নদী ছিল জালজালিয়াতির মাধ্যমে সেখানে বিআরএস নকশায় নদীর স্থলে ব্যক্তি মালিকানা দেখিয়ে ভরাটের মাধ্যমে মাছের ঘের, রাস্তা, দোকান তৈরি করে নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে দেয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে প্রবাহ। দখলদারদের দৌরাত্ম্যের কারণে শুধু নদীই মরে নাই বিপর্যয়ের মুখে প্রাণ-প্রকৃতি। প্রশাসনের নজরদারি ও কার্যকার পদক্ষেপের অভাবে আজ নদীর এই করুণ দশা। এখনো যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়া যায় তাহলে নদী এবং জলধারা গুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। সঙ্কটে পড়বে পরিবেশ প্রতিবেশ।

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের সভাপতি মোহাম্মদ নুরুজ্জামান সিপন বলেন, নদী মরে যাওয়ায় যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে কৃষি, তেমনি স্থানীয় জাতের মাছ বিলীন হওয়াসহ বিলুপ্ত প্রায় ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরাও। তাই নদী পুনঃখনন ছাড়া এ অঞ্চলের কৃষি ও জীবিকা টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান জানান, কীর্তিনাশার শাখা নদীটি নাব্যতা হারানোর ফলে কচুরিপানা ও ময়লা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকরী পদক্ষেপ ও স্থানীয়দের আবেদনের প্রেক্ষিতে নদীটিকে আমরা পুনঃপ্রবহমান করার প্রকল্প হাতে নিতে পারব। যাতে নদী আবার তার নিজের রূপ ফিরে পায়।