জাতিসঙ্ঘকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘুদের কথা ভুলে না যাওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন রোহিঙ্গা বক্তারা। তারা রাখাইনে লড়াই অব্যাহত থাকায় নির্যাতিত মুসলিম সংখ্যালঘুদের দুর্দশা থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে না নেয়ার আকুল আবেদন জানান। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ (ইউএনজিএ) রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা মং সাওয়ায়েদুল্লাহ মঙ্গলবার নিউ ইয়র্ক সিটির জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের বিশাল হলে এক লাইভ স্ট্রিমিং বক্তৃতায় বলেন, ‘প্রিয় রোহিঙ্গা ভাই ও বোনেরা, তোমাদের ভুলে যাওয়া হয়নি। তোমাদের মনে হতে পারে যে বিশ্ব তোমাদের দুর্দশা দেখছে না। রোহিঙ্গারা তোমাদের দেখছে। এখন এই বার্তা বিশ্ব নেতাদের এবং জাতিসঙ্ঘের জন্য : রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রকাশের পর আট বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার কোথায়? কোথায়?’
এরপর তিনি নদীতে পড়ে থাকা বেশ কয়েকজনের লাশের ছবি তুলে ধরেন, যারা গত বছর আগস্টে মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান সেনাবাহিনীর ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এগুলো একটি নিয়মতান্ত্রিক অভিযানের অংশ।’ সাওয়ায়েদুল্লাহ ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে সাত বছর ছিলেন। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘আরাকান সেনাবাহিনীর এই অমানবিক নৃশংসতা কেন প্রতিরোধ করা হচ্ছে না?’
উইমেন্স পিস নেটওয়ার্ক-মিয়ানমারের নির্বাহী পরিচালক ওয়াই ওয়াই নু, আল জাজিরাকে বলেন যে, এই অনুষ্ঠানটি একটি ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’, যা তিনি আশা করেছিলেন ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।’ ওয়াই ওয়াই নু তার বক্তৃতায় বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যেখানে রোহিঙ্গারা রয়েছে। এই সহায়তা আমরা ‘যদি আমরা এটি পাই, তাহলে সম্মেলনটি মূল্যবান, আমাদের রাখাইন রাজ্যের ভেতরে রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে হবে।’
নু আল জাজিরাকে আরো বলেন, ‘অনেক সদস্যরাষ্ট্র তাদের বক্তৃতায় মূল কারণগুলো সমাধান এবং ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা এগিয়ে নেয়ার ওপর জোর দিয়েছে বা তুলে ধরেছে।’ জাতিসঙ্ঘের এই অনুষ্ঠানটি আরো দেখিয়েছে যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য একটি ‘সুসঙ্গত এবং সমন্বিত পদ্ধতি’ প্রয়োজন যেখানে ‘নেতৃত্ব এবং সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আসিয়ান অঞ্চল’, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর একটি গোষ্ঠী। তিনি বলেন, দেশগুলোর জন্য মিয়ানমার এবং ‘আরাকান আর্মিসহ সামরিক ও অন্যান্য সশস্ত্র ক্ষেত্রসহ সব অপরাধীর’ ওপর লক্ষ্যবস্তু নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ, সেইসাথে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার জন্য ‘বিশ্বব্যাপী অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা’ প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।
‘ব্যাপক সাহায্য কর্তন’
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব শেফ ডি ক্যাবিনেট আর্ল কোর্টেনে র্যাট্রে-এর পক্ষে জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘ব্যাপক সাহায্য কর্তন’ রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরো খারাপ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযান থেকে পালিয়ে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। গত ১৮ মাসেই আরো এক লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, যারা উদারভাবে তার সীমান্ত উন্মুক্ত রেখেছে এবং তাদের আশ্রয় দিয়েছে,’ র্যাট্রে বলেন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ‘অসাধারণ আতিথেয়তা এবং উদারতা’ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এ সম্মেলনে বলেন, তার দেশ আট বছর ধরে সঙ্কটের মধ্যে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা অব্যাহত রাখতে লড়াই করছে। গণহত্যা শুরু হওয়ার এত বছর পরও, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অব্যাহত রয়েছে। ড. ইউনূস গত মাসে কক্সবাজারে যৌথভাবে বৈঠকের পাশাপাশি একই রকম আরেকটি শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন, যাতে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।
ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ এই সঙ্কটের শিকার, আমরা বিশাল আর্থিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত মূল্য বহন করতে বাধ্য হচ্ছি, তহবিল হ্রাস পাওয়ায়, একমাত্র শান্তিপূর্ণ বিকল্প হলো তাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা। রোহিঙ্গারা ধারাবাহিকভাবে তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে, যারা সম্প্রতি সঙ্ঘাত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাদের অবশ্যই প্রত্যাবাসনের অনুমতি দিতে হবে।’
ইউনূস সভায় আরো বলেন যে, থাইল্যান্ডের মতো, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের কাজের অধিকার দিতে পারে না, কারণ তার নিজের দেশের ‘বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যসহ উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জ’ রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত চার্লস হার্ডার, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ৬০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করবে’, যা রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ প্রদানের জন্য ‘অর্থপূর্ণ’ পরিবর্তন আনতে কাজে লাগানো হবে এবং বাংলাদেশ এ উদ্যোগে জড়িত থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে শরণার্থীদের অর্থায়ন ‘এমন বোঝা নয়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করবে। রোহিঙ্গাদের জন্য টেকসই সমাধান তৈরির সময় এখন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
জাতিসঙ্ঘের প্রায় ৫০টি সদস্যরাষ্ট্র মঙ্গলবার রোহিঙ্গা নিয়ে এ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, যদিও যুক্তরাজ্য ছাড়া খুব কমসংখ্যক রাষ্ট্রই তাদের গৃহীত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে, যারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ৩৬ মিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দেয়।
গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী দাউদা জালোও বলেন যে, তার দেশ আশা করে আগামী বছরের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মৌখিক শুনানির ‘শীঘ্রই’ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রায় দেবে। আমরা প্রায় ছয় বছর আগে, ২০১৯ সালের নভেম্বরে আমাদের মামলা দায়ের করেছি। এখন আমরা এই মামলার যোগ্যতার ভিত্তিতে মৌখিক শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, যা আদালত ২০২৬ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় নির্ধারণ করেছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য মিয়ানমার কেন দায়ী এবং তার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সে বিষয়ে গাম্বিয়া তার মামলা নিয়ে লড়াই অব্যাহত রাখবে।