রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর আজ। ২০০৬ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাথে বাম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা লগি-বৈঠা দিয়ে রাজপথে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে। এ দিন মোট ১৩ জন নিহত হন। এর মধ্যে রাজধানীতেই জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছয়জন এবং ছাত্রমৈত্রীর একজন কর্মী প্রাণ হারান। লগি-বৈঠার নির্মম প্রহার, গুলি আর ইটপাটকেলের আঘাতে রাজধানীর পল্টন এলাকাতেই নিহত হন ছয়জন। ওই দিন প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার পরে লাশের ওপর উন্মত্ত নৃত্যে হতবাক হয় বিশ^। এ ঘটনায় পল্টন ও শাহবাগ থানায় পৃথক পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়। পল্টন থানায় দায়ের করা পাল্টাপাল্টি দু’টি মামলার একটি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই প্রত্যাহার করা হয়। ক্ষমতাসীন ১৪ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অন্য মামলাগুলোও পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ওই সব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা আসামি ছিলেন। অন্য দিকে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের আসামি করে যে মামলাটি দায়ের হয়েছিল, তা উচ্চ আদালত স্থগিত করে রেখেছেন। সেই দিনের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা স্মরণ হলে আজও আঁতকে ওঠেন মানুষ।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের হতাহতের ঘটনা ঘটে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল আহূত অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে। ওই দিন প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে রাস্তায় মহড়া দিতে দেখা যায় পেশাদার সন্ত্রাসীদেরকে। ওই দিন জামায়াত-শিবিরের নিহত নেতাকর্মীরা হলেন মোজাহিদুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন (১), জসিম উদ্দিন (২), গোলাম কিবরিয়া শিপন, ফয়সাল ও হাবিবুর রহমান। প্রকাশ্যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষের সামনে এদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পরে দুর্বৃত্তরা লাশের ওপরে উঠে উন্মত্ত নৃত্য করে। আহত জামায়াতের অপর একজন সাইফুল্লাহ মো: মাসুম ঘটনার দুই দিন পর হাসপাতালে মারা যান। একই সময় পল্টন মোড়ে নিহত হন ছাত্রমৈত্রীর খিলগাঁও থানা সাধারণ সম্পাদক রাসেল খান। সহিংস ঘটনায় পল্টন ও এর আশপাশের এলাকাতেই আহত হন কমপক্ষে এক হাজার মানুষ।
এ ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন পল্টন থানা জামায়াতের তৎকালীন আমির এ টি এম সিরাজুল হক। মামলা নম্বর ৬১, তারিখ ২৯.১০.২০০৬। এ মামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, মো: নাসিম, আবদুর রাজ্জাক, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননসহ ৪০ জন এজাহার নামীয় আসামিসহ সহস্রাধিক আসামি করা হয়। আহত মাসুম মারা যাওয়ার পরে ৩ নভেম্বর আর একটি সম্পূরক এজাহার দাখিল করা হয়। এই এজাহারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ ২৩ জন এজাহার নামীয়সহ দুই শতাধিক লোককে আসামি করা হয়। এই অভিযোগটি দাখিল করেন মাসুমের ভাই মো: শামসুল আলম মাহবুব। অন্য দিকে ছাত্রমৈত্রীর রাসেল খান নিহতের ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ মোট ১০ জনকে আসামি করে পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদি হয়েছেন ওই সময়ের ঢাকা মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কামরুল আহসান। মামলা নম্বর ৬২(১০)২০০৬। এ মামলায় ৬১ নম্বর মামলার বাদি সিরাজুল হককেও আসামি করা হয়। এ ঘটনায় পল্টন থানায় আরো তিনটি এবং শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
পল্টন থানায় দায়ের করা ৬১ নম্বর মামলায় ২০০৭ সালের ১০ এপ্রিল ৪৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। চার্জশিট নম্বর ১৪৪। ধারা ১৪৩/ ১৪৮/ ১৪৯/ ৩২৩/ ৩২৫/ ৩২৬/ ৩০৭/ ৩০২/ ১০৯/ ১১৪ দণ্ডবিধি। পরে যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয় তারা হলেন- আবদুল জলিল, মোহাম্মদ নাসিম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, সাহারা খাতুন, হাজী সেলিম, ডা: এইচ বি এম ইকবাল, আবদুস সালাম ওরফে সেলিম, সবুজ, আলী, মনা, রতন, আবুল, বাবু ওরফে নাজির আহম্মদ, জাকির ওরফে জাকির হোসেন, শফিকুল ইসলাম, সালাউদ্দিন খোকন, সুলতান মিয়া, আবুল কাশেম, আলমগীর ওরফে গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর, নওসের আলী, আবদুল লতিফ ওরফে ক্ষ্যাপা, মো: জাকির হোসেন, শাহরিয়ার ওরফে সোহেল শাহরিয়ার, শাহাবুদ্দিন কিরণ, জাহাঙ্গীর হায়দার চৌধুরী, আশরাফ হোসেন, টিটু, ওমর ফারুক, শেখ হাসিনা, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সিদ্দিক নাজমুল আলম, রাসেল, মজিবুর রহমান মাইজ্জা, বেলায়েত হোসেন, আবু সাঈদ, বশির আহম্মদ, কিরণ ওরফে আবদুল মালেক, সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শর্টগান সোহেল, জাহাঙ্গীর আলম, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী, মোস্তাকিম বিল্লাহ, মুকুল, রায় মোহন শীল ও সুমন।
এই চার্জশিট ২০০৭ সালের ২৪ এপ্রিল আদালতে গৃহীত হয় এবং আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে পরোয়ানা মূলতবি করা হয়। ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণের পরে ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট এ মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। অন্য দিকে কামরুল আহসানের দায়ের করা মামলায় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০০৯ সালের ৫ মে এ মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করা হয়। কিন্তু মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়নি। উচ্চ আদালতে এ মামলাটি কোয়াশমেন্টের আবেদন করা হলে মামলাটি উচ্চ আদালত থেকে স্থগিত করে রাখা হয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের টার্গেট ছিল জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সে দিনই হত্যা করা। এ জন্য তারা সে দিন সারা দেশ রক্তাক্ত করে। ওই ঘটনায় তখন মামলা করা হলেও পরে অধিকতর তদন্তের নামে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করে রাখা হয়। তার পরে হাসিনা ক্ষমতায় এসে বেআইনিভাবে মামলাটি বাতিল করে। তিনি ওই মামলা পুনরুজ্জীবিত করে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মো: নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, শাপলা চত্বরের গণহত্যার শহীদ পরিবারের মতোই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারকে এবং আহত-পঙ্গুত্ব বরণকারীদের আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসন করতে হবে।



