২০২৬ সালের মাধ্যমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণের খরচ নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ আসছে। যদিও এর আগে প্রথম দফায় উচ্চ মূল্যের কারণে কয়েকটি দরপত্র বাতিল করা হয়েছিল কিন্তু এখন আবার প্রেস মালিকদের সাথে আঁতাত করে নবম শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণের খরচ বাড়ানোর পথেই হাঁটছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কাগজের স্পেসিফিকেশন এবং অন্যান্য শর্ত একই রকম থাকলেও মাধ্যমিকের বই মুদ্রণেই দুই ধরনের খরচ হিসাব করা হচ্ছে। সূত্র জানায় ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণে যেখানে প্রতি ফর্মা গড় খরচ দুই টাকা ৮০ পয়সা প্রেস মালিকরাই দরপত্র দিয়েছেন, সেখানে নবম শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণের জন্য খরচ ফর্মা প্রতি চূড়ান্ত করা হয়েছে তিন টাকা ২০ পয়সা। অর্থাৎ একই কাগজ, কালি, প্লেট, গাম, বাইন্ডিং, পরিবহন ও অন্যান্য খরচ হিসাব করে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণে প্রেস মালিকরাই সর্বনি¤œ দরপত্র জমা দিয়ে কাজ পেয়েছেন সেখানে ওই একই স্পেসিফিকেশনে নবম শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণের খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি ফর্মা তিন টাকা ২০ পয়সা। এই অতিরিক্ত অর্থ কেন এবং কোন খাতে খরচ হচ্ছে তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা এনসিটিবি থেকে পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তিনটি শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণে পুনঃদরপত্র আহ্বানে সরকারের ৩২১ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। আগের দরপত্রে যে দর প্রেস মালিকরা জমা দিয়েছিলেন সেখান থেকে পুনঃদরপত্রে প্রতিটি বইয়ের দরও অনেক কমেছে। সূত্র জানায়, এনসিটিবির পক্ষ থেকে যে প্রাক্কলিক দর নির্ধারণ করা হয়েছে প্রেস মালিকরা তার চেয়ে ৪৫ শতাংশ কম দর দিয়ে বই ছাপতে দরপত্র দিয়েছেন। এরপরেও তারা (প্রেস মালিকরা) কম-বেশি লাভ অবশ্যই করবেন। কেউ লোকসান হয়তো করবেন না। যদিও মন্ত্রণালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপে প্রেস মালিকদের আগের সেই চিরচেনা সিন্ডিকেট এখন ভেঙে গেছে। তবে এরপরেও এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের টেন্ডারে এমন কারসাজির সুযোগ দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
অবশ্য ইতোমধ্যে এনসিটিবি স্বীকার করেছে যে, সম্প্রতি ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণে বাতিল হওয়া দরপত্রের তুলনায় পুনঃদরপত্রের দর অনেক কম হওয়ায় ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপাতে সরকারের খরচ কমেছে প্রায় ৩২১ কোটি টাকা। কিন্তু এত কম দামে নির্ধারিত শর্ত মোতাবেক পাঠ্যবই দেয়া প্রেস মালিকদের জন্য শুধু বাড়তি চাপই নয় বরং অনেক অসাধ্যও বটে। আর এ কারণেই মূলত মানহীন বইয়ের আশঙ্কাও করছেন কর্মকর্তারা। পুরনো ও অভিজ্ঞ প্রেস মালিকদের অনেকেই জানান, পুনঃদরপত্র হওয়ায় সব প্রক্রিয়া শেষে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম এই শ্রেণীর বই ছাপা শুরু হতে সময় লেগেছে। অন্য দিকে ৯ম শ্রেণীর বই ছাপাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পরই বই ছাপা শুরু হবে। গতকাল সোমবার এনসিটিবিতে গিয়ে জানা যায়, এদিন নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের দরপত্র নিয়ে (টেক) মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভার সারসংক্ষেপ আজ মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা রয়েছে। তবে এনসিটিবির পক্ষ থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ হয়েছে যে, যেখানে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবই মুদ্রণের দর অনেক কমে দেয়া হয়েছে, সেখানে নবম শ্রেণীর বইয়ের দর উচ্চ হারের অনুমোদন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
এনসিটিবি সূত্রে আরো জানা গেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি বই ৩০০ লটে (প্রতি শ্রেণীতে ১০০ লট) ছাপার জন্য ২০৭ কোটি ফর্মা (৮ পৃষ্ঠা ১ ফর্মা হিসাবে) কাগজ প্রয়োজন হবে। এই তিন শ্রেণীর বাতিল হওয়া দরপত্রে দরদাতাদের দেয়া গড়ে দর ছিল ৩ টাকা ১৯ পয়সা (প্রতি ফর্মা)। কিন্তু সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদে এই ক্রয় প্রস্তাব বাতিল হওয়ায় ৩০০ লটের পুনঃদরপত্র সম্প্রতি উন্মুক্ত করা হয়। নতুন দরদাতারা প্রতি ফর্মায় আগের দরপত্রের তুলনায় গড়ে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৫০ পয়সা কমিয়েছেন। এতে ২০৭ কোটি ফর্মার বই ছাপাতে এনসিটিবি তথা সরকারের খরচ কমছে প্রায় ৩১০ কোটি টাকার বেশি। বই ছাপার সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি আগের (বাতিল) দরপত্রে প্রতি ফর্মার দর ৩ টাকা ১৯ পয়সা না হয়ে ২ টাকা ৭০ বা ২ টাকা ৮০ পয়সা হলে হয়তো এটি বাতিল হতো না।
এ দিকে ২০২৬ সালের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর বইয়ের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর দিয়ে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ নিয়ে কারো কারো মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি থাকতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান। আবার একই সাথে বেশি মূল্য দিয়ে বই মুদ্রণের জন্য এনসিটিবির কোনো কর্মকর্তা বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন কিনা সেটিও অনুসন্ধানের দাবি রাখে। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, বছরের শেষ সময়ে বইয়ের কোয়ালিটি যাচাই করার সুযোগ থাকে না। তখন শুধু বই গণনা করেই স্কুলে স্কুলে পাঠানো হয়। আর এই সুযোগে কিছু প্রেস মানহীন বই সাপ্লাই করেন। এই সুযোগ কেউ যাতে না পায় সেই উদ্যোগও নিতে হবে।



