ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গজুড়ে মিরপুরের রূপনগরে আগুনে দগ্ধ লাশের গন্ধে টেকা দায়। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। স্বজনরা ভিড় করেছেন নিকটজনের লাশ যদিবা পাওয়া যায়। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনের পোড়া লাশ দেখে। তাদের একজনের কথা- সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে গিয়ে আমার আদরের সন্তানটা এভাবে লাশ শুয়ে থাকবে কল্পনাও করতে পারিনি। মর্গে সন্তানের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজধানীর শিয়ালবাড়ি এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডে নিহত মো: রবিউল ইসলামের মা। রবিউলের বড় ভাই তাইজুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ভাই সেই ভবনের তিনতলায় একটি গার্মেন্টে কাজ করত। মঙ্গলবারের সকালে কাজে গিয়েছিল, বলেছিল দুপুরে আসবে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল, কিন্তু আর ফিরে এলো না। এখন তার পোড়া লাশটা দেখতে হবে ভাবতেই পারছি না। আমরা লাশ শনাক্ত করলেও হাসপতাল থেকে বলেছে সব কাজ শেষ হলে তবে হস্তান্তর করবে।
নিহত নার্গিস আক্তারের (১৮) বাবা ওয়াজিউল্লাহ বলেন, আমার মেয়েটি সবেমাত্র এইচএসসি পাস করেছে। নতুন চাকরি পেয়ে বলেছিল, সংসারের ভার কিছুটা আমি নেবো। কাজে যোগ দেয়ার ১৩ দিন হতেই তার লাশের জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এখন তাকে হারানো কষ্টের ভার আমাকে সইতে হবে। আগুন লাগার পর অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার সন্ধান না পেয়ে অবশেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসে লাশ শনাক্ত করি।
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে রাসায়নিকের গুদাম ও পোশাক কারখানায় আগুনে নিহত ১৬ জনের লাশ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০ জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে স্বজনরা। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে লাশ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানায় ঢামেক কর্তৃপক্ষ। নিহতদের মধ্যে ছয়টি লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তারা হলেন- মাহিরা আক্তার (১২), নার্গিস আক্তার (১৮), সানোয়ার হোসেন (২৫), মো: নুর আলম (২৩), আল মামুন (৩৮) ও মো: রবিউল ইসলাম (২৮)। বুধবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মর্গে ফরেনসিক বিভাগের লেকচারার ডা: ফারহানা ইয়াসমিন ডিএনএ নমুনা ও ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন।
সরেজমিন দেখা যায়, ঢামেকের মর্গের সামনের আহাজারি করছেন আগুনের নিহতের স্বজনরা। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে পুরো হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। নিখোঁজদের খোঁজে ছুটে আসা অনেকেই লাশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। কেউ কেউ লাশ শনাক্ত করে ভেঙে পড়েছেন কান্নায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে সকাল থেকেই ছিল ভিড়। অগ্নিকাণ্ডের পর যেসব দেহগুলোর বেশির ভাগই আর চেনার মতো নেই। সবার পুরো শরীর আগুনে পোড়ে গেছে। তাই পোড়া চামড়া, বিকৃত মুখ, গলে যাওয়া পোশাক- সব কিছু যেন সময়ের নিষ্ঠুর সাক্ষী হয়ে আছে। কিছু লাশের এখনো সন্ধান না পেয়ে ছোটাছুটি করছেন আপনজনরা।
স্বজনরা হাসপাতালের মর্গের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রিয়জনের লাশটিকে নিয়ে যেতে। মর্গের বাতাসে মিশে আছে পোড়া গন্ধ আর হাহাকার। অনেক দেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে, চেনা সম্ভব নয়; তাই নেয়া হচ্ছে ডিএনএ নমুনা। এই পরীক্ষার ফলাফল মিললে তবেই হস্তান্তর করা হবে লাশ স্বজনদের হাতে। কিন্তু সেই অপেক্ষা যেন অসহ্য হয়ে উঠছে অনেকের জন্য। মর্গের ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে আসা সাদা কাপড়ে ঢাকা, পাশে নম্বর লেখা লাশ দেখে এগিয়ে আসেন স্বজনরা। কেউ চিনতে পারছেন, কেউ পারেন না। ডিএনএ টেস্ট শেষে যখন লাশ হাতে পাবে বলে জানায় দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা।
তবে স্বজনদের অভিযোগ, তারা মঙ্গলবার রাত থেকে হাসপাতালে অপেক্ষা করছে কিন্তু বুধবার এখনো পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ কিছুই বলতে পারছে না। তারা বলছে, দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা আমাদের হয়রানি করছে। নিহতের লাশ শনাক্ত করার পরও ফিরিয়ে দিচ্ছে না। তারা বলছে এখনো কাজ শেষ হয়নি।
নিহত ফারজানার চাচা জামাল মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সকালে আমাদের বলেছে বিকেলের দিকে লাশ দিয়ে দেবে। কিন্তু এখন বলছে দেবে না। কখন দেবে সেটিও তারা বলতে পারছে না। পুলিশ সকালে আসার কথা থাকলেও দুপুরের দিকে আসে। এতে কাজ শেষ করতে দেরি হয়ে যায়। তারা এখন বলছে ময়নাতদন্ত শেষ করে তবে লাশ দেবে। আগে বলেছে ডিএনএ টেস্ট করবে কিন্তু এখন ভিন্ন কথা বলছে। আমরা আর কত অপেক্ষা করব। এ দিকে অনেক লাশ বাইরে ফেলে রেখেছে অযতেœ অবহেলায়।
এ ছাড়া আগুনের নিহতদের মধ্যে ১৪ নম্বর ব্যাগের লাশকে দুই পরিবার নিজেদের বলে দাবি করছে। একপক্ষ বলছে এটি তাদের সন্তুান, যার নাম তোফায়েল আহমেদ। সে ওই ভবনের তিনতলায় আরএন ফ্যাশনে কাজ করত। অপরপক্ষ দাবি করছে এ ব্যাগের লাশটি তাদের সন্তান। আর তার নাম হলো আবদুল আলিম। তবে পুলিশ এ বিষয়ে সঠিক কোনো সমাধান দিতে না পারায় দুই পরিবারের মধ্যে সন্দেহ বিরাজ করছে। তবে ডিএনএ পরীক্ষা একমাত্র সমাধান বলে মনে করছেন ঢামেক কর্তৃপক্ষ।
রূপনগর থানার এসআই মো: মুখলেছুর রহমান জানান, আগুনের ঘটনায় ১৬টি লাশ মধ্যে ছয়টি লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ছয়জনের পুরো ঠিকানা পাওয়া গেছে বৃহস্পতিবার সকালের দিকে অন্যদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। আমরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্বজনদের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করব। আর বাকি ১০টি লাশ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন ও ডিএনএ সংগ্রহ করে স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান জানান, ডিএনএ সংগ্রহ করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে নমুনা সংগ্রহ করছেন। পরে স্বজনদের কাছ থেকেও সংগ্রহ করা হবে ডিএনএর নমুনা। প্রক্রিয়াটি সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলছে। ডিএনএ পরীক্ষার পর লাশগুলো হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে। জেলা প্রশাসকের অনুমতি পেলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হবে।
মঙ্গলবার এই অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জন নিহত হন। সবার লাশ পোশাক কারখানার ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে উদ্ধার করা হয়। ওই ভবনের নিচতলায় আগুনের তীব্রতা থাকায় এবং ছাদে ওঠার দরজা দু’টি তালা দিয়ে বন্ধ থাকায় অনেকেই ভবন থেকে বের হতে পারেননি। ফলে ওই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আটকে আগুনে পুড়ে নিহত হয়েছেন তারা।
 


