ভূমিকম্পে ঢাকায় ৫ লাখ বাড়ি ক্ষতির আশঙ্কা বেশি

সামনের শক্তিশালী ভূমিকম্প থেকে আহত ও নিহতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে এবং অবকাঠামোগুলোর ধসে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে রেট্রোফিট পদ্ধতি প্রয়োগের বিকল্প নেই। কারণ ভবনগুলো অনেকেই ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে চাইবেন না।

হামিম উল কবির
Printed Edition

বড় ভূমিকম্প হলে ধসে যেতে পারে অনেক ভবন অথবা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু জাপানি প্রযুক্তিগত জ্ঞান ব্যবহার করে দুর্বল সেই ভবনগুলোই মজবুত করা সম্ভব। তখন বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলেও দাঁড়িয়ে থাকবে ভবনগুলো, যেমন জাপানের ভবনগুলোর কিছু হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রযুক্তিটির নাম রেট্রোফিটিং, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূমিকম্পে আহত ও নিহতের সংখ্যায় কমিয়ে আনা যায়। এটা করা হলে বাড়তি কিছু অর্থ খরচ হবে কিন্তু বেঁচে যাবে আপনজন এবং ভবনে বাসবাসকৃত মানুষগুলো।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর অনেক ভবন ধসে যেতে পারে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে মোট ২১ লাখ ভবন রয়েছে। ১৫ লাখের কিছু বেশি ভবন এক থেকে দুই তলা বিশিষ্ট। পাঁচ লাখ ভবন রয়েছে ছয় তলা বিশিষ্ট। অপর দিকে ১০ তলা বা এর চেয়ে বেশি তলা বিশিষ্ট ভবনের সংখ্যা খুবই কম। ভূমিকম্পে ছয় তলা ভবনগুলো নিয়ে শঙ্কা বেশি। কারণ এই ভবনগুলোতে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা রয়েছে। এসব ভবনের অনেক অনেক আগের। পুরনো হওয়ার কারণে এমনিতেই এগুলো বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। আবার অনেক আগে নির্মাণের কারণে বিএনবিসি নীতিমালা অনুসারে নির্মাণ করা হয়নি। শক্তিশালী মাত্রার ভূমিকম্প হলে এসব ভবন ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারবে না।

ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, সামনের শক্তিশালী ভূমিকম্প থেকে আহত ও নিহতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে এবং অবকাঠামোগুলোর ধসে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে রেট্রোফিট পদ্ধতি প্রয়োগের বিকল্প নেই। কারণ ভবনগুলো অনেকেই ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে চাইবেন না।

দুর্বল ভবন মজবুত করতে বাংলাদেশে বেশ কিছু বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের কোনো সক্ষমতা নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন রাজউকের এ ধরনের সক্ষমতা নেই। তবে তারা মনিটরিং করার দায়িত্বটি নিয়ে রেট্রোফিট করার পর ভবনটি ভূমিকম্পে সহনীয় হলো কি না, সেই সার্টিফিকেট দিতে পারে। অধ্যাপক আনসারী বলেন, ১০ তলা বা বহুতল বিশিষ্ট ভবনগুলোকে নিয়ে শঙ্কা কম, কারণ এসব ভবন বিএনবিসির নীতিমালা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মাটির নিচে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কয়েকটি ছোট ছোট ভূমিকম্প ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কমপক্ষে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পে। খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এর চেয়ে বেশি শক্তির ভূমিকম্প হলে আরো বেশি ক্ষতি হতে পারে এতে সবাই একমত। সে কারণে ভবনগুলো বিশেষ ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর বিদ্যমান ভবনগুলো শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে অনেক ভবন নির্মিতই হয়েছে জাতীয়ভাবে বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) প্রণয়নের আগে। বিএনবিসি প্রণয়ের আগের ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় করে তৈরি করা হয়নি। তা ছাড়া কিছু ভবন মালিক অর্থ বাঁচাতে কোনো মতে একটি কাঠামোর মধ্যে ভবন তৈরি করে ফেলেছেন প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়াল যোগ না করেই। সেই ভবনগুলো বড় ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে না।

রেট্রোফিটিং শুধু ভবনকে শক্তিশালী করে না বরং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও নতুন মাত্রা যোগ করে। ধসে পড়ার সম্ভাবনা কমে গেলে জীবনহানি, চিকিৎসা ব্যয়, সম্পদের ক্ষতি এবং নগরজুড়ে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার পরিমাণও কমে আসে। একটি ভবন ভেঙে গেলে তা শুধু একটি পরিবার বা একটি প্রতিষ্ঠান নয়, পুরো এলাকার ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, রাস্তা, যোগাযোগ সব কিছুতেই বড় ধরনের ক্ষতি হয়। কিন্তু রেট্রোফিটিং করা ভবন ভূমিকম্পের আঘাত পেলেও দাঁড়িয়ে থাকে, অন্তত ধসে পড়ে না। ফলে মানুষের জীবন রক্ষা পায় এবং পুনরুদ্ধারের ক্ষতিও অনেক কম হয়।

এতে কলামের চার পাশে অতিরিক্ত উপাদান যোগ করা হয়। কলামের চার পাশে আরো রড ও কংক্রিট যোগ করে কলামকে আরো শক্ত করা হয়। কলামের চার দিকে স্টিল প্লেট বা অ্যাঙ্গেল বসানো হয়। এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা হলে ভবন বেশি লোড নিতে পারে ও ভূমিকম্প ঝাঁকুনি দিলে ধসে পড়ে না। পুরনো ভবনের বিমে লোডিং ক্ষমতা কম থাকলে কার্বন ফাইবার রিইনফোর্সড পলিমার (সিএফআরপি) ব্যবহার করে বিমকে শক্তিশালী করা যায়। শিয়ার ওয়াল ব্যবহার করে ভবনকে মজবুত করা যায়। ভবনের ভরাট দেয়াল তৈরি পরিবর্তে এই পদ্ধতিতে বিশেষ আরসিসি দিয়ে তৈরি করা হয়। এটা করা হলে ভূমিকম্প হলে ভবন কম ঝাঁকুনি খায়। এ ছাড়া ফাউন্ডেশন ও তলা শক্তি বাড়ানো হয় বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে। এভাবে একটি শক্তিশালী ভবন তৈরি করা যায়।