এডিসি আখতারুল বলেছিলেন, আন্দোলনকারীদের ফায়ার করে মেরে ফেল

এসআইয়ের জবানবন্দী

গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দী দিয়েছেন পুলিশের এসআই মো: আশরাফুল ইসলাম। সেখানেই তিনি এ কথা বলেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি চানখাঁরপুল এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহ্ আলম মো: আখতারুল ইসলাম। অধস্তন পুলিশ সদস্যদের আখতারুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘তোমাদের যাদের কাছে পিস্তল ও চায়না রাইফেল আছে, তারা আন্দোলনকারীদের ফায়ার (গুলি) করে তাদেরকে মেরে ফেলো।’

গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দী দিয়েছেন পুলিশের এসআই মো: আশরাফুল ইসলাম। সেখানেই তিনি এ কথা বলেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি চানখাঁরপুল এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি বলেন, তাকেও গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক এডিসি আখতারুল। তবে তিনি গুলি করা থেকে বিরত ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা একটি মামলায় এসআই আশরাফুল গতকাল ৩৯তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন। তার আগে এদিন আরো দু’জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হলেন ৩৭তম সাক্ষী চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ হাসান এবং ৩৮তম মো: সোহেল মাহমুদ।

প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আজ মঙ্গলবার দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।

আশরাফুল ইসলাম ১৯৯৪ সালে পুলিশে যোগ দেন। ২০০২ সাল থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) কর্মরত আছেন। ২০১৮ সালে এসআই (সশস্ত্র) হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। জবানবন্দীতে এসআই আশরাফুল ইসলাম বলেন, তৎকালীন এডিসি আখতারুল ইসলামের নির্দেশে তৎকালীন এসি ইমরুল, ইন্সপেক্টর আরশাদ, আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ জন এপিবিএন সদস্য, ডিএমপির ১০ থেকে ১৫ জন সদস্যের সাথে তিনি হেঁটে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার দিকে চানখাঁরপুলে পৌঁছান। চানখাঁরপুলসংলগ্ন বংশাল ও চকবাজার এলাকা থেকে আসা ছাত্র-জনতা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে শাহবাগের দিকে যেতে চাইলে এডিসি আখতারুল ইসলামের নির্দেশে কোনো প্রয়োজন ছাড়া সাউন্ড গ্রেনেড, গ্যাস গান ও শটগান দিয়ে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এই গুলি করা হয় চানখাঁরপুল মোড়ে। এপিবিএন পুলিশকে দিয়ে শটগান ফায়ার করে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়। ওই সময় এডিসি আখতারুল বলেন, ‘তোমাদের যাদের কাছে পিস্তল ও চায়না রাইফেল আছে, তারা আন্দোলনকারীদের প্রতি ফায়ার করে তাদেরকে মেরে ফেলো।’

তখন এসআই আশরাফুল ইসলামসহ কয়েকজন এই অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধ আদেশ পালন না করলে এডিসি আখতারুল তাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকেন বলেও জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন তিনি। এসআই আশরাফুল ইসলাম বলেন, তৎকালীন এডিসি আখতারুল তাদের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তোরা সরকারের বেতন রেশন খাস না? গুলি করবি না কেন? তোদের চাকরি খেয়ে নিবো।’ তারপরও তিনি (এসআই আশরাফুল) তার পিস্তল দিয়ে ফায়ার (গুলি) করা থেকে বিরত থাকেন।

জবানবন্দীতে এসআই আশরাফুল ইসলাম বলেন, তারপর এডিসি আখতারুলের সরবরাহ করা অতিরিক্ত গুলি ব্যবহার করে তার (আখতারুল) নির্দেশে ও দেখানো মতে কনস্টেবল মো: নাসিরুল ইসলাম রাস্তায় বসে চায়না রাইফেলে গুলি লোড করেন এবং আন্দোলনকারীদের টার্গেট করে বারবার ফায়ার (গুলি) করতে থাকেন। এ সময় এডিসি আখতারুল ইসলাম এপিবিএন পুলিশের কনস্টেবল অজয়ের হাত থেকে চায়না রাইফেল কেড়ে নিয়ে এপিবিএন পুলিশের কনস্টেবল সুজন হোসেনের হাতে দেন। অজয় গুলি করা থেকে বিরত ছিলেন। এরপর তৎকালীন কনস্টেবল সুজন হোসেন চানখাঁরপুল মোড়ে কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো শুয়ে, কখনো হাঁটু গেড়ে বসে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করতে থাকেন।

এ ছাড়া এপিবিএনের কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন তার নামে ইস্যুকৃত চায়না রাইফেল দিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করেন। আমি দেখতে পাই উক্তরূপ গুলিতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে অন্য আন্দোলনকারীরা তাদেরকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর এসি ইমরুল স্যার, ইন্সপেক্টর আরশাদ স্যার এপিবিএনের ৫-৭ জন সদস্য নিয়ে নাজিমুদ্দিন রোডের বিভিন্ন গলিতে গুলি করতে করতে প্রবেশ করলে আমরা চায়না রাইফেলের গুলির শব্দ শুনতে পাই।

এরপর শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে শুনতে পেয়ে বেলা আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটের দিকে চানখাঁরপুল এলাকার পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন এডিসি আখতারুল স্যারের নির্দেশে টিএসটি মোড় হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে শাহবাগ থানার পিছন দিক দিয়ে থানায় প্রবেশ করি। এডিসি আখতারুল স্যারের নির্দেশে নিজ নিজ নামে ইস্যুকৃত অস্ত্রগুলো শাহবাগ থানার অস্ত্রাগারে জমা দেই। আমার সঙ্গীয় কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম তার নামে ইস্যুকৃত চায়না রাইফেলের ৪০ রাউন্ড গুলি জমা করলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি- তুমি চানখাঁরপুলে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করার পরও ৪০ রাউন্ড গুলি কিভাবে জমা করলে? উত্তরে সে জানায়- এডিসি আখতারুল স্যার আমাকে অতিরিক্ত গুলি সরবরাহ করেছে। এরপর পোশাক পাল্টে সিভিল ড্রেস পরে এশার নামাজের পরে শাহবাগ থানার পিছন দিয়ে বের হয়ে পায়ে হেঁটে ছাত্র-জনতার সাথে মিশে মিরপুর পুলিশ লাইনে রাত আনুমানিক ১১টায় পৌঁছাই।

গ্যারেজ থেকে তুলে নিয়ে হৃদয়কে গুলি, লাশও গুম : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অংশ নেন হৃদয়। তবে তার আর ঘরে ফেরা হয়নি। পুলিশের গুলিতে মারা যান তিনি। লাশটিও গুম করে ফেলা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া প্রত্যক্ষদর্শী সোহেল মাহমুদের জবানবন্দীতে উঠে এসেছে এমন তথ্য। শেখ হাসিনার মামলায় ৩৮তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন সোহেল।

জবানবন্দীতে সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকালে আমার বাড়ির পাশে শরিফ মেডিক্যালের সামনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যাই। ওই দিন কারফিউ ছিল। ছাত্রদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিও ছিল। দুপুর ১২টায় আমি বাড়ি চলে আসি। বাড়িতে থাকতেই শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন বলে জানতে পারি। এরপর আবারো শরিফ মেডিক্যালের সামনে যাই। সেখানে গিয়ে হাজারও লোককে বিজয় মিছিল নিয়ে এদিকে আসতে দেখি। আর উলটো দিক থেকে মিছিলকে লক্ষ্য করে টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও গুলি করতে থাকে পুলিশ। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি।’

‘ওই সময় আমিসহ কিছু লোক আমার বাড়িতে আশ্রয় নেই। আমার বোনজামাই হাফিজুর রহমান তপনের রিকশা গ্যারেজে আশ্রয় নেন কিছু লোক। ছাদ থেকেই তাদের দেখতে পাই। কারণ গ্যারেজটি আমার বাড়ির পাশেই। ওই সময় গ্যারেজ থেকে একজনকে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এরপর আমার বাড়ির পাশের কবরস্থানের কাছে নিয়ে তাকে গুলি করেন তারা। এতে ঘটনাস্থলেই ওই লোক মারা যান। সাথে সাথেই লাশটি থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। গুলি করার সময় ওসি আশরাফ ও ডিবির একজন কর্মকর্তা ছিলেন। পরে গুলিবর্ষণকারীর নাম জানতে পারি। তিনি হলেন কনস্টেবল আকরাম। আর নিহতের নাম হৃদয়।’

পরদিন তথা ৬ আগস্ট হৃদয়ের লাশটি পুলিশ গুম করে ফেলেন বলেও জানতে পারেন এই প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, ‘থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্রসহ হৃদয়ের লাশ নিয়ে পালিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। আমি এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, অন্যান্য মন্ত্রী, স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দায়ী করছি। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন পলাতক শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন।’

সকালে জানতে পারি পুলিশ লাশ নিয়ে পালিয়ে গেছে : গাজীপুর কোনাবাড়ী থানা রোডে শরিফ মেডিক্যাল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মো: সোহেল মাহমুদ। তিনি ৩৮তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিয়েছেন। ঘটনার বিষয়ে সোহেল মাহমুদ গতকাল সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১ এ তার জবানবন্দীতে বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকালে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শরিফ মেডিক্যালের সামনে গিয়েছিলাম। ওই দিনই ছাত্রদের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলছিল এবং একই দিনে দেশে কারফিউ ছিল।