ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে ঢাকা। বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল পর্যন্ত কয়েক দফায় ভূমিকম্পে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য সতর্ক বার্তা। এমন পরিস্থিতিতে দেশে যেকোনো সময় বড় ভূমিকম্প হতে পারে। যাতে ঢাকা ভয়ানক বিপর্যয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ জন্য সবচাইতে বেশি প্রয়োজন ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, দেশে বড়ো ভূমিকম্পসহ দুর্যোগ মোকেবেলায় প্রযুক্তিতে ঢাকার অবস্থান জিরো। তবে ছোট ভূমিকম্প মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিস সক্ষম জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বড় দুর্যোগে কোনো দেশের পক্ষেই একা সামাল দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রয়োজনে বাংলাদেশও অন্যদের সহযোগিতা নেবে।
একাধিক সংস্থার তথ্যানুয়ায়ী রাজধানীতে প্রায় ২১ লাখ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ভবন ছয় তলার বেশি। ৯৪ ভাগ ভবনই অননুমোদিত। বড় ধরনের কম্পন হলে এই উচ্চ ভবনগুলোর ওপরই সর্বাধিক ঝুঁকি তৈরি হবে। ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট। এর মধ্যে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা।
বৃহস্পতিবার থেকে কয়েক দফা ভূমিকম্পের আচরণের বিষয়টি বিশ্লেষণ করে বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদি আহমেদ আনসারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো: জিল্লুর রহমান বলেন, ওই ভূমিকম্প আবার হবেই, এটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারণ হচ্ছে যেখানে ভূমিকম্প হয়, সেখানে শক্তি সঞ্চার হয়। এই শক্তিটা ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়, একপর্যায়ে তার আশপাশের পাথর, মাটি ভেঙে যাবে। ভেঙে গিয়ে যদি বিচ্যুত হয়ে যায়, তখনই বিপর্যয় ঘটে। তার ভাষ্য, বড় ধরনের কম্পন সাধারণত দেড় শতকের ব্যবধানে ফিরে আসে। সেই হিসেবে আবারও ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি সামনে চলে এসেছে। তার মতে, আজকের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে সতর্ক হওয়ার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে।
অন্য দিকে ভূমিকম্পবিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, মাটির নিচে জমে থাকা শক্তি বের হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। আর পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের মতে, প্রায় ৯০ ভাগ পুরনো ভবনে বিল্ডিং কোড না মানায় ঢাকা ও পুরান ঢাকা ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেনের মতে, এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশের সক্ষমতাও নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, যে কোনো দুর্যোগে আমরা ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতা নেই। তবে প্রযুক্তিতে আমাদের সব প্রস্তুতি আছে বলা যাবে না। আর থাকলেও বড় বড় যন্ত্রগুলো সব জায়গায় নেয়া যায় না। এক ভবনের সাথে লাগা আরেক ভবনে কেউ সমস্যায় পড়লে কিভাবে উদ্ধার হবে। এ জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। তবে যা প্রযুক্তি আছে তা যথাযথ না হলে খারাপ না। এর বাইরে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের সব প্রস্তুতি আছে। অন্য দিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর (উপসচিব) উপপ্রকল্প পরিচালক আবু সাইদ মো: কামাল বলেন, বড় দুর্যোগে আমাদের প্রযুক্তিগত অবস্থান বলা যায় একেবারে নেই, জিরো। তিনি বলেন এ নিয়ে আমাদের টেন্ডার আদান প্রদান চলছে। তার জন্য সময় প্রয়োজন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সিনিয়র স্টাফ অফিসার, সংযুক্ত : মিডিয়া সেল মো: শাহজাহান শিকদার বলেন, বড় ভূমিকম্প মোকাবেলার যান্ত্রিক সক্ষমতা তাদের নেই। তবে ছোট দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে। আরো প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বড় দুর্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের সব দেশেই বড় দুর্যোগে অন্য দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। যেমন তুরস্কে ভূমিকম্পে দুর্যোগের সময় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ সহযোগিতা করেছে। তাই বড় দুর্যোগে বাংলাদেশও প্রয়োজনে অন্যের সহযোগিতা নেবে।
ভূমিকম্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৪ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল আগারগাঁও থেকে ৯ কিলোমিটারের মধ্যে। সেই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ১০ কিলোমিটার গভীরে। ২০০৮ সালের ২৬ জুলাই ময়মনসিংহে ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল ১৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার গভীরে। ২০১০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে উৎপত্তি হওয়া ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল ১৬ কিলোমিটার গভীরে। ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ছিল আগারগাঁও থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে, ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আগারগাঁও থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরের টাঙ্গাইলে উৎপত্তি হয়েছিল ৩ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প।
এ ছাড়া ২০২৩ সালে ঢাকার আশপাশে ৩টি ভূমিকম্প হয়েছে। যার মধ্যে সর্বশেষ গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয় রাজধানী ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে। এর আগে একই বছর ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে উৎপত্তি হয়। রিখটার স্কেলে এটি ছিল ৪ মাত্রার। অন্যটি ৫ মে ঢাকা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে দোহারের কাছে উৎপত্তি হয়। রিখটার স্কেলে এটি ছিল ৪ দশমিক ৩ মাত্রার।



