কোটা আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান

কিন্তু এ বিজয় কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়; এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ প্রতিরোধ, রক্তের মূল্য, আত্মত্যাগ এবং এক অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থান।

খালিদ সাইফুল্লাহ
Printed Edition
রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকার শেখ মুজিবুর রহমানের মুর্তির গলায় দড়ি দিয়ে টেনে ভেঙে ফেলে বিক্ষুব্ধ জনতা
রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকার শেখ মুজিবুর রহমানের মুর্তির গলায় দড়ি দিয়ে টেনে ভেঙে ফেলে বিক্ষুব্ধ জনতা |নয়া দিগন্ত

আজ ৫ আগস্ট। বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। গত বছরের এ দিনে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত গণ-আন্দোলনে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে এদিন বিকেলে শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন। কিন্তু এ বিজয় কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়; এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ প্রতিরোধ, রক্তের মূল্য, আত্মত্যাগ এবং এক অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থান।

কোটা সঙ্কট থেকে আগুন ছড়ানো শুরু : ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। পরদিন ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামেন। ৯ জুন আন্দোলন আরো ঘনীভূত হয় এবং শিক্ষার্থীরা ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে দাবি মানার আলটিমেটাম দেন। আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শাহবাগ, জাহাঙ্গীরনগর, রেললাইন, মহাসড়ক-সব জায়গায় শুরু হয় অবরোধ।

‘বাংলা ব্লকেড’ : ছাত্র আন্দোলনের নতুন অধ্যায় : এক সময় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদরাসা পর্যন্ত আন্দোলনে শামিল হয়। ছাত্ররা কাস-পরীক্ষা বর্জন করে ঘোষণা দেয় ‘বাংলা ব্লকেড’। ৭ জুলাই এ কর্মসূচি রাজধানীকে কার্যত অচল করে ফেলে। ৮ জুলাই আন্দোলনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় টিম গঠিত হয়। ছাত্রদের ঐক্য ও সাংগঠনিক দতা আন্দোলনে নতুন গতি এনে দেয়।

‘তুমি কে? আমি কে?’- স্লোগানে জেগে ওঠে দেশ : ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের রাজাকার বংশধর বলে কটাক্ষ করেন। এর প্রতিবাদে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে উত্তাল হয়ে ওঠে ছাত্রসমাজ। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্লোগান : ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার!’

এ স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ক্যাম্পাসগুলোতে উঠে আসে এক নতুন ভাষা, নতুন কণ্ঠস্বর। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আরো তীব্র হয়।

রক্তে লেখা অধ্যায় : আবু সাঈদ ও ১৬ জুলাই : ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ। বুক পেতে গুলি খাওয়ার সেই দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ ও বেদনাভরা ঐক্য। একই দিনে চট্টগ্রামে নিহত হন ওয়াসীম, শান্ত, ফারুক এবং ঢাকায় শাহজাহানসহ আরো কয়েকজন। আন্দোলন পরিণত হয় এক জাতীয় প্রতিরোধে।

কারফিউ, ইন্টারনেট, শাটডাউন, প্রবাসীদের সহায়তা : ১৮ জুলাই ছাত্রদের ডাকে সারা দেশে শুরু হয় কমপ্লিট শাটডাউন। সরকার মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেশকে কার্যত অন্ধ করে তোলে। কারফিউ জারি হয়, সেনা মোতায়েন শুরু হয়। তবু আন্দোলন থামে না; বরং প্রবাসী বাংলাদেশীরা টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান।

একের পর এক হত্যাকাণ্ড, তবু থামেনি মিছিল : ১৯ জুলাই বিজিবি ও পুলিশের হামলায় নিহত হন দুই শতাধিক ছাত্র-জনতা। হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়ে নিহত হয় শিশু রিয়াও। ২০ জুলাই থেকে শুরু হয় অব্যাহত দমন-পীড়ন ও গুম-খুনের অধ্যায়। ছাত্রদের বিভক্ত করার কৌশলে সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২৯ জুলাই শেখ হাসিনা জামায়াত নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন, যা আন্দোলনকে দমন করার আরেকটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রতিভাত হয়।

আগস্টের শোক নয়, ছিল প্রতিরোধের সূর্য : সরকার ঘোষিত ‘শোকের আগস্ট’ প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীরা পালিত করে ‘জবসবসনবৎরহম ঙঁৎ ঐবৎড়বং’ কর্মসূচি। ২ আগস্ট থেকে শুরু হয় ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই’ এক দফা আন্দোলন। সারা দেশে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল হয়, শহীদদের জন্য কফিন মিছিল, গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

৫ আগস্ট : এক দফা, এক দাবি : ৫ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। লাখো মানুষ ঢাকায় জড়ো হন। পুলিশের গুলিতে অনেক নিহত হলেও সেনাবাহিনী গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে তারা ভারতে পালিয়ে যান। বেলা ২টা ৩০ মিনিটের পর থেকে টেলিভিশনে প্রচারিত হয় শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষণা। বিকেলে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সূচনা : ৮ আগস্ট রাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। গঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদ। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে একটি ঐকমত্য ভিত্তিক রূপরেখা ঘোষণা করা হয়।

ফ্যাসিবাদী শাসনের এক পর্যালোচনা : ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দল দমন, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বাচন ব্যবস্থার ধ্বংস, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের দলীয়করণের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি একদলীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে গণরায়কে উপেক্ষা করে ক্ষমতায় থাকা সরকার ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ভোটে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রহসনের আশ্রয় নেয়। বিএনপি-জামায়াতসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে বিবেচিত হয়।

একটি বিজয়ের যন্ত্রণাময় উৎসব : ৫ আগস্ট গণভবনে বিজয়ী জনতার ঢল নামে। রাস্তায় রাস্তায় আল্লাহর কাছে সিজদা করে মানুষ। মিষ্টি বিতরণ, কোলাকুলি, এবং চোখে জল সব মিলে ছিল এক করুণ অথচ গর্বের জয়োৎসব। তবে আন্দোলনে শহীদ হওয়া সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা ও আহতদের পরিবারে নেমে আসে দীর্ঘশ্বাস আর শোক। ৬ আগস্ট থেকে বন্দী আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের মুক্তি শুরু হয়।

ইতিহাস রচিত হয়েছিল- ছাত্রদের হাতে : শহীদ আবু সাঈদ, তামীম, রিয়া গোপসহ শত শত ছাত্র-জনতা, নিরীহ পথচারী তাদের রক্তে লেখা হয় এক নতুন ইতিহাস। একদিকে ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসনের পতন, অন্য দিকে নতুন স্বপ্নের শুরু।

৫ আগস্ট তাই শুধু একটি তারিখ নয়; এটি একটি চেতনার নাম- গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সম্মিলিত প্রতিরোধের এক মহাসমারোহের দিন।