সংলাপে সিইসিকে রাজনৈতিক নেতারা

কোনোভাবেই অনিয়ম ও অদৃশ্য শক্তির কাছে নতজানু হবেন না

ইসির একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব না : সিইসি

নির্বাচনে সবার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতে নির্বাচন কমিশনকে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা উচিত বলে অভিমত দিয়েছেন সংলাপে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেন, জাতীয় সংসদের আসন সীমানা নিয়ে ইসির সিদ্ধান্তের বিপক্ষে আদালত হস্তক্ষেপ করছে। এটি কাম্য নয়। কারণ নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। তাই বিষয়টি তাদের এখতিয়ারেই থাকা উচিত।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition
১২টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে সংলাপে বক্তব্য রাখছেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন
১২টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে সংলাপে বক্তব্য রাখছেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন |নয়া দিগন্ত

অতীতের মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন জাতি মেনে নেবে না। নতজানু না হয়ে শক্তভাবে নির্বাচন করুন। কোনোভাবেই অনিয়ম ও অদৃশ্য শক্তির কাছে নতজানু হওয়া যাবে না। তাই নির্বাচনে সবার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতে নির্বাচন কমিশনকে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা উচিত বলে অভিমত দিয়েছেন সংলাপে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেন, জাতীয় সংসদের আসন সীমানা নিয়ে ইসির সিদ্ধান্তের বিপক্ষে আদালত হস্তক্ষেপ করছে। এটি কাম্য নয়। কারণ নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। তাই বিষয়টি তাদের এখতিয়ারেই থাকা উচিত। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একা এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে জাতীয় নেতৃবৃন্দ, যাদের সরাসরি ভোটারদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে, তাদের সহযোগিতা অপরিহার্য।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে গতকাল আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসি আয়োজিত রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপে এসব অভিমত ব্যক্ত করেন ১২টি রাজনৈতিক দলের নেতারা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে চার কমিশনার, ইসি সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সকালের সংলাপে গণফোরাম, গণফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। আর বিকেলে অংশ নেয়, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), তৃণমূল বিএনপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতারা।

গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, গণভোট যেন শেষ পর্যন্ত হাস্যকর কিছুতে পরিণত না হয়, সেই বিষয়ে ইসিসহ সংশ্লিষ্টদের লক্ষ রাখতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনে সব দলের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। বিগত সরকারের সময়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল। এবার সেটা হলে দেশের মানুষ মেনে নেবে না।

ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর জনগণের ভোট দেয়ার পরিবেশ ছিল না। ফ্যাসিবাদী শক্তি একতরফা নির্বাচন করেছে। তাই আসন্ন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হওয়ায় মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। তবে এখনো প্রতিনিয়ত আস্থাহীনতা কাজ করছে। তিনি বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায় যেনতেনভাবে। এমনটি হলে জনমনে ক্ষোভ আরো বাড়বে। এ জন্য কমিশনের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসেন রাজি বলেন, ৫ আগস্টের আগে ফ্যাসিস্ট শক্তির সহায়তায় একটি চক্র আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করেছিল। আমাদের নেতাদের জেলে দেয়া হয়। তারা ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে ছিল। অথচ আজ তারা এখানে এসে আমাদের আসন দখল করেছে। এতে আমরা ব্যথিত হয়েছি। যারা তিনটি নির্বাচনে ভোটাধিকার হরণ করেছে, তারা কিভাবে ভোট চাইবে তা বোধগম্য নয়।

গণফ্রন্টের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ব্যারিস্টার মো: আকমল হোসেন বলেন, অতীতে তিনটি নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এবার মানুষ উৎসবমুখর ভোটে শামিল হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক আচরণ পরিহারের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব শাহ মোহাম্মদ আসলাম হোসাইন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে দেশের মানুষ হতাশ হবে। তাই কমিশনকে নির্বাচন বিতর্কিত করার যেকোনো অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সরকারের সাথে কোনো আলোচনায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। তখন সরকারের দায়িত্ব শুধু ইসির সিদ্ধান্ত পালন করা। এ ছাড়া গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসাথে করার সিদ্ধান্তটি একটি বড় অসঙ্গতি। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভোটার গণভোটে অংশ না নিলে নির্বাচনই হুমকির মুখে পড়বে। অতীতে নির্বাচন কমিশন সরকারের ইচ্ছা পূরণ করেছে, যা অত্যন্ত খারাপ ছিল। বর্তমান ইসির কাছে এখন সুযোগ এসেছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ক্ষমতা হারানো, শেখ হাসিনার পতন বিএনপি-জামায়াত বা নতুন কোনো শক্তির কারণে হয়নি, বরং এটি ছিল আল্লাহর গজব, যা তিনি অসন্তুষ্টি তৈরি করার ফলে এসেছে।

তিনি নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারকে বাইরে রেখে ভোট করলে ভালো নির্বাচন করতে পারবেন না। আওয়ামী লীগ ইলেকশন বন্ধ করার চেষ্টা করবে।

সিইসি বলেন, আচরণবিধি দীর্ঘদিন ধরে ওয়েবসাইটে রাখা হয়েছিল এবং রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত মতামতের ভিত্তিতে এতে সমন্বয় করা হয়েছে। একটি সুন্দর নির্বাচন অনেকাংশে নির্বাচনী আচরণবিধি সুষ্ঠুভাবে পালন করার ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে এবং তাদের দলের কর্মীদের কাছে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সিইসি দায়িত্ব গ্রহণের পর কমিশনের বড় কিছু কাজের কথা তুলে ধরে জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদ একটি বিশাল উদ্যোগ ছিল। প্রায় ৭৭ হাজার কর্মী মাঠে কাজ করেছেন। প্রায় ২১ লাখ মৃত ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে এবং ৪০ লাখেরও বেশি ভোটার, যারা যোগ্য হলেও তালিকায় নাম ছিল না, শনাক্ত করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তিনি নতুন উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখ করেন, প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যা অত্যন্ত জটিল ও নতুন উদ্যোগ। এ ছাড়া নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত প্রায় ১০ লাখ লোক যাতে নিজেরা ভোট দিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। দেশের বাইরে পোস্টেড সরকারি চাকরিজীবীদের ভোট এবং কারাগারে থাকা নাগরিকদের ভোট ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়ার কথাও উল্লেখ করেন সিইসি।