কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে উৎসাহিত করতে প্রভিশন সংরক্ষণে শিথিলতা

২০২৫ সালের জুন প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ, আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা প্রায় ২০ শতাংশ।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে উৎসাহিত করতে প্রভিশন সংরক্ষণে শিথিলতা আনলো বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, এখন থেকে কৃষি ও সিএমএস (কটেজ, মাইক্রো ও স্মল) উদ্যোক্তা খাতে মানসম্মত (স্ট্যান্ডার্ড) ও বিশেষ নজরদারি (এসএমএ) শ্রেণীর ঋণের বিপরীতে সমানভাবে ১ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হবে। পূর্বে স্ট্যান্ডার্ড ঋণের জন্য ১ শতাংশ এবং এসএমএ ঋণের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হতো। নতুন এ নিয়ম ৩১ ডিসেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ, আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা প্রায় ২০ শতাংশ।

এত বিপুল খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বাড়িয়ে তুলছে এবং নতুন ঋণ প্রদানের সক্ষমতাকে সীমিত করছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, প্রভিশন হার কমানোর ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক চাপ কিছুটা লাঘব হবে। এতে ব্যাংকগুলোর হাতে নতুন ঋণ দেয়ার মতো তহবিল বাড়বে। বিশেষ করে কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাতে এই অর্থ প্রবাহিত হলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।

বাংলাদেশের কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ খাতকে সবচেয়ে কর্মসংস্থানমুখী দু’টি খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে এসব খাতে বিনিয়োগ বাড়লে উৎপাদন ও আয় উভয়ই বৃদ্ধি পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এই উদ্যোগ সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তবে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের একাংশ এই সিদ্ধান্তে ঝুঁকি দেখছেন। তাদের মতে, যখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখন প্রভিশন কমানো একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। প্রভিশন হচ্ছে সেই নিরাপত্তা বলয়, যা ব্যাংককে ভবিষ্যৎ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। প্রভিশন হার কমালে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে, বিশেষ করে যদি কৃষি বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণেও খেলাপি বাড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রভিশন একটি অপরিহার্য উপাদান। তাই এই শিথিলতা যেন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক দিকে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ রাখছে, অন্য দিকে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রভিশন শিথিল করেছে যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

তারা মনে করেন, যদি এই সিদ্ধান্তের যথাযথ নজরদারি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এটি ব্যাংক খাতের তারল্য সঙ্কট কাটাতে সহায়ক হবে এবং একই সাথে কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতের জন্য তাৎক্ষণিক স্বস্তি এনে দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি কতটা স্থিতিশীলতা আনবে তা নির্ভর করবে ঋণ ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ওপর। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে না আনলে প্রভিশন কমানোর সুফল টেকসই হবে না। তবে সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে এই নীতি দেশের কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাতে নতুন গতি সঞ্চার করতে পারে।