শফিকুল আলম টিটন
উপমার চঞ্চলতায় সবাই যেমন অতিষ্ঠ তেমনি মনে মনে ভীষণ খুশি। যাক মেয়েটা বোকাসোকা নয়। সপ্রতিভ জবাবে মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে যান মা-বাবা। পড়াশোনায় বেশ ভালো। ক্লাসে ফার্স্ট হতে না পারলেও প্রথম পাঁচজনের একজন।
আজ দুপুর থেকে কোনো খাওয়া দাওয়া নেই। কারো সাথে কোনো কথা নেই। মুখ ভার করে বসে আছে। মাঝে মাঝে দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। হাত দিয়ে মুছতে মুছতে আগডুম বাগডুম ভেবেই চলেছে। টেবিলের ওপর দুই হাত রেখে মাথা গুঁজে পড়ে আছে। ভাবতে ভাবতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল ও।
চমৎকার রাত। ঝলসে ওঠা রূপালী চাঁদ তার রূপের আলোটুকু ঢেলে দিয়েছে উপমার বাগান বাড়িতে। অনেক জায়গাজুড়ে বাগান করে রেখেছেন বাবা। গাছ প্রিয় বাবা মনের মাধুরী মিশিয়ে বাগান তৈরি করে রেখেছেন। পূব পাশে আম আর কাঠাল গাছ। তার গা ঘেঁষে বড়ই গাছ। বাড়ির পশ্চিমে রয়েছে হরেক রকম ফুল গাছ। গোলাপ, জবা, বেলি, হাসনাহেনাসহ নানান ফুলের সমাহার। বাড়ির দরজা থেকে বাইরে বেরুনো পর্যন্ত ১০ ফিটের চওড়া রাস্তা। এক পাশে রয়েছে সবজি বাগান।
অবসরে বাবা যখন বাগানে কাজ করে তখন উপমা বাবাকে কাজে সহযোগিতা করে। বাবার সাথে বাগানে কাজ করতে খুব আনন্দ পায় উপমা। তৃপ্তি সহকারে কাজ করে ও। বিকেলের সময়টুকু ও ফুল বাগানেই ঘুরঘুর করে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাগানে চলে আসে। ওর খুব প্রিয় টকটকে লাল গোলাপ গাছটা কে যেন তুলে নিয়ে গেছে। তাই দেখে কান্না। মুখ ভারী করে সারাদিন কিছুই মুখে দেয়নি। ওর প্রিয় গোলাপ গাছটা কে তুলে নিয়ে গেল?
পূর্ণিমার রাতে পুরো ফুল বাগানটা যেন খলখল করে হাসছে। যখনই ওর প্রিয় গোলাপ গাছটির শূন্যতা দেখে ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। গুটিসুটি পায়ে ও এগিয়ে যায় ফুল বাগানের দিকে।
জবা ফুলের ওপর বসে থাকা সুন্দর একটা ফড়িং। রাণী ফড়িং। তার পাশে হাসনাহেনা ফুলের ওপর বসে থাকা প্রজাপতি ফড়িংকে বলছে, দেখ, দেখ মেয়েটা কি সুন্দর! এই ফুল বাগানের খুব যতœ নেয়। কী সুন্দর বাগানটা দেখ!
- ঠিক বলেছিস। কত সুন্দর পরিপাটি এই ফুল বাগান। আহারে পরী যদি ফুল বাগানের লাল গোলাপ গাছটা না চুরি করত তাহলে খুব ভালো হতো।
আহারে বেচারীর মনটা খুব খারাপ। আমাদেরই খারাপ লাগছে ওর মন খারাপ দেখে। ঠিক বলেছিস। প্রজাপতি বলল।
ফড়িং আর প্রজাপতির কথা চুপি চুপি সব শুনছিল উপমা। এক গাল হেসে এগিয়ে এলো আরো কাছে।
তোমরা আমার বন্ধু হবে? উপমা হাসিমুখে বলল । অমনি ফড়িং আর প্রজাপতি উড়ে এসে ওর হাতের ওপর বসে।
তোমরা কী জানো আমার গোলাপ ফুল গাছটা কে উপড়ে নিয়ে গেছে।
দুষ্টু পরী। ফড়িং বলল।
ঠিক। প্রজাপতি বলল। ওই দুষ্টু পরী প্রতিদিন তোমার ফুল বাগানে এসে ফুলের ঘ্রাণ নিত। যেদিন যে ফুলটা পছন্দ হতো সেদিন সেই ফুলটা নিয়ে যেত। গতকাল দেখি তোমার টকটকে লাল গোলাপ গাছটাই উপড়ে নিয়ে গেছে। আমরা তো ছোট তাই কিছুই বলতে পারিনি।
মনটা খারাপ হয়ে যায় উপমার।
আজ তুমি থাকো। আজও আসবে ওই দুষ্টু পরীটা। আচ্ছা।
কিছুক্ষণ বাদে দেখে অপরূপ সুন্দর এক পরী নেমে এলো ফুল বাগানে। বিশাল বড় তার পাখা দুটি। আড়ালে চলে গেল উপমা, ফড়িং আর প্রজাপতি।
পরী ঘুরে ঘুরে ফুল বাগানের ঘ্রাণ নিতে থাকল। হাসনাহেনার সামনে এসে দাঁড়ায় পরী। গাছটি উপড়ে ফেলতে হাত বাড়িয়েছে মাত্র। অমনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো উপমা। দাঁড়াও। অমনি থতমত খেয়ে যায় পরী। ঘুরে দাঁড়ায় উপমার মুখোমুখি।
তুমি আমার গোলাপ ফুল গাছটা না বলে নিয়ে গেছ। এখন হাসনাহেনা গাছটার দিকে হাত বাড়িয়েছ। তুমি আমার ফুল গাছ চুরি করছ কেনো? তুমি জানো আমি কত কষ্ট করে এই গাছের যতœ নেই। পরী এবার মুখ খুলল। তুমি কিছু মনে করো না। পরীর রাজ্যে আমাদের রাণী মা ভীষণ ফুল পছন্দ করে। তিনি তোমার যতেœ গড়া ফুল বাগান দেখে গেছে। তাই প্রতিদিন আমাকে পাঠায় ফুল নিতে। গতকাল রাণী মার মন খারাপ ছিল। তাই তিনি বললেন, লাল টুকটুকে গোলাপ গাছটা তুলে নিয়ে যেতে। তাই বলে আমার প্রিয় বাগানের গাছগুলো তুলে নিয়ে যাবে। তুমি জানো মন খারাপ করে আমি সারাদিন কিছুই খাইনি।
আমার ফুল বাগানের সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছো। তুমি আমার সাথে কেনো এমন করলে?
ঠিক আছে সই আমি আর তোমার বাগানের একটাও ফুল ছিঁড়ব না। কেমন?
আচ্ছা। অন্ধকারে ঢাকা মুখের মেঘ সরতে শুরু করল। হাত বাড়িয়ে দিলো উপমা।
আজ থেকে আমরা চারজন বন্ধু, কেমন?
চারজনের কথা শুনে পরীর মুখ হা হয়ে গেল। বলল, এখানে তো আমরা দুজন। আর বাকি দুজন কে কই?
কেন? এই যে রাণী ফড়িং আর রঙিন প্রজাপতি।
ওদের দেখাতে পরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো উপমা। ও আচ্ছা। পরী খুব সহজেই সায় দিলো। ওদের দেখে উপমা বলল, এখন থেকে প্রতিদিন রাতে তোমরা আমার ফুল বাগানে আসবা। আমরা একসাথে খেলা করব। কেমন?
ফড়িং, প্রজাপতি আর পরী একে একে সায় দিলো। তাহলে এখন তোমরা চলে যাও। কাল আবার আসবে।
না। পরী বলল। তুমি যখন ঘুমিয়ে যাবে তখন আমি তোমার লাল টুকটুকে গোলাপ গাছটা এখানে রেখে যাবো। তুমি সকালে বাগানে এলে দেখতে পারবে। ভালো থেকো সই।
ওরা তিনজন একে একে সবাই উড়ে গেল। মিলিয়ে গেল আকাশে।
রাতে ভালো ঘুম হলো না ওর। কখন সকাল হবে ! ওর প্রিয় গোলাপ গাছটিকে দেখতে পারবে। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল উপমার। তাড়াহুড়ো করে ফুল বাগানের কাছে আসতেই দেখে ওর পছন্দের সেই লাল টুকটুকে গোলাপ ফুল গাছটা ওর দিকে চেয়ে খলখল করে হাসছে। হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো নড়েচড়ে উঠল, এমনটি মনে হলো উপমার কাছে।
মা ডাকছে। কিরে মামনি। কাল সারাদিন কিছুই খাসনি। না খেয়ে ঘুমালে রাজার হাতি দুরুম করে গায়ের ওপর পড়ে!! এক গাল হেসে মা বলত লাগল। উঠে পড় মা। সকাল হয়ে গেছে। চোখ কচলাতে কচলাতে মায়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় উপমা।
মা আমার লাল টুকটুকে গোলাপ গাছটা দুষ্টু পরী তুলে নিয়ে গেছে। তুমি কি জানো?
মারে আমার জেনে কাজ নেই। তুমি উঠে গিয়ে দেখো তোমার গোলাপ গাছ তার জায়গাতেই আছে। তোমার বাবা খুব ভোরে গাছে পানি দিয়ে এসেছে?
ওমা তাই!! বলো কী মা? তাহলে কি দুষ্টু পরী আমার প্রিয় গোলাপ গাছটি আবার রেখে গেছে। উপমার বিড়বিড় করে কথা বলা দেখে মা বলল, কী বলবি মা?