সেন্টমার্টিনে প্রথম যাত্রায় তিন জাহাজে ১১৭৪ যাত্রী

পর্যটকদের উচ্ছ্বাসে দ্বীপে প্রাণচাঞ্চল্য

সরকারি নির্দেশনা মেনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক যেতে পারবেন অনুমতিপ্রাপ্ত জাহাজগুলোতে, পরবর্তী দুই মাস (৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত) থাকছে দ্বীপে রাত্রিযাপনের সুযোগ। যাত্রার ক্ষেত্রে পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।

গোলাম আজম খান, কক্সবাজার অফিস
Printed Edition

দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে পুনরায় চালু হয়েছে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল। দীর্ঘ ৯ মাস পর আবারো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে সেন্টমার্টিনে। পর্যটকদের জন্য থাকছে রাত্রিযাপনের সুযোগও। গতকাল সোমবার সকাল ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে গিয়েছে তিনটি জাহাজ। প্রথম এই যাত্রায় ছিলেন এক হাজার ১৭৪ জন পর্যটক। তারা ছিলেন খুবই উৎফুল্ল। জাহাজে ছবি তোলা থেকে শুরু করে গান-বাজনা কিংবা প্রকৃতি উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। সেন্টমার্টিন ভ্রমণে প্রশাসনের সব নির্দেশনাও মানতে রাজি তারা। এর আগে জেটিঘাটে যাত্রীদের স্বাগত জানান প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

ভোর থেকেই ঘাটে আসা শুরু করেন এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, এমভি বার আউলিয়া ও কেয়ারি সিন্দাবাদ নামের জাহাজগুলোর যাত্রীরা। টিকিট প্রদর্শন করে জাহাজের আসন গ্রহণের আগে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যাত্রীদের প্রত্যেকের হাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে তুলে দেয়া হয় পরিবেশবান্ধব পানির বোতল। ঢাকা থেকে আসা পর্যটক অরূপ হোসেন বলেন, প্রথমবারের মতো সেন্টমার্টিন যাচ্ছি, সত্যিই খুব রোমাঞ্চকর লাগছে এই ভ্রমণ। প্রশাসনের তৎপরতাও প্রশংসনীয়, আশা করছি সময়গুলো ভালো কাটবে।

সরকারি নির্দেশনা মেনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক যেতে পারবেন অনুমতিপ্রাপ্ত জাহাজগুলোতে, পরবর্তী দুই মাস (৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত) থাকছে দ্বীপে রাত্রিযাপনের সুযোগ। যাত্রার ক্ষেত্রে পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।

জাহাজমালিকদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ছয়টি জাহাজকে প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে, যাত্রীর আনুপাতিক হার বিবেচনায় এ দিন তিনটি জাহাজ গেছে। জোয়ার-ভাটা ও নদীর নাব্যতা বিবেচনায় প্রতিদিনের যাত্রার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজগুলো বিকেলে আবার কক্সবাজারের উদ্দেশে ফিরবে।

গত বছর থেকে টেকনাফ রুটে বন্ধ রয়েছে জাহাজ চলাচল, ফলে কক্সবাজার থেকে দীর্ঘ সমুদ্রপথ অতিক্রমে ভ্রমণ কিছুটা ক্লান্তিদায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম থেকে আসা পর্যটক রোকসানা আলী। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিন আমার পছন্দের জায়গা, অনেকবার গিয়েছি। আগে টেকনাফ থেকে দ্রুত যাওয়া যেত; কিন্তু এখন সেটি হচ্ছে না। এত দূরত্বের জার্নি একটু কষ্টের। তবুও তৃপ্তি মিলবে দ্বীপে পৌঁছে, কারণ সেখানে প্রাকৃতিক প্রশান্তি আছে।

ঘাটে প্রবেশের সময় তল্লাশির পাশাপাশি পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা নিয়োজিত ছিলেন। পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটের কক্সবাজার রিজিয়নের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ জানান, পর্যটকরা যাতে নির্বিঘেœ সেন্টমার্টিন যাত্রা উপভোগ করতে পারেন সে লক্ষ্যে আমাদের সার্বক্ষণিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। সমুদ্রপথে জাহাজে এবং সেন্টমার্টিনে আমাদের সদস্যরা নিরাপত্তা দেবে, যেকোনো প্রয়োজনে সহায়তা দিতে আমরা প্রস্তুত।

এ দিকে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গত অক্টোবরে ১২টি নির্দেশনা জারি করে সরকার। দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, উচ্চ শব্দে অনুষ্ঠান, বারবিকিউ পার্টি, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়াফল সংগ্রহ ও ক্রয়-বিক্রয় এবং সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এ ছাড়া সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ মোটরযান চলাচল বন্ধ এবং নিষিদ্ধ পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক ব্যবহারও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে প্রথম যাত্রার প্রারম্ভে পরিদর্শনে এসে জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন বদ্ধপরিকর, এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পর্যটক ও সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কাম্য।

গত ১ নভেম্বর থেকে পর্যটকদের জন্য সেন্টমার্টিন উন্মুক্ত করা হয়। তবে নভেম্বর মাসে সেখানে রাত্রিযাপনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ ছিল। রাতে থাকার সুযোগ না থাকায় সেন্টমার্টিনগামী আগ্রহী পর্যটক কম ছিল এবং এ কারণে কক্সবাজার থেকে গত নভেম্বর মাসে কোনো জাহাজ সেন্টমার্টিন যায়নি।

জেটিঘাটে আসা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো: শাহিদুল আলম জানিয়েছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সঙ্ঘাতের কারণে ২০২৩ সালে টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকে জাহাজ চলাচল করছিল না। তবে মেরিন ড্রাইভের ইনানীর নৌবাহিনীর জেটিঘাট থেকে জাহাজ চলাচল করছিল। গত বছর কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিøউটিএ’র জেটিঘাট থেকে সাগরপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করছে। চলতি বছরেও একই ঘাট থেকে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

জাহাজ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রথম দিনের সব টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। তিনটি জাহাজে মোট এক হাজার ১৭৪ যাত্রী দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হন। তবে ম্যানুয়ালি টিকিট বিক্রি করায় একটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিদিন সকাল ৭টায় জাহাজ সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছাড়বে, পরদিন বেলা ৩টায় কক্সবাজারে ফিরবে।

এ দিকে সেন্টমার্টিন থেকে শাহপরীর দ্বীপের উদ্দেশে ছেড়ে আসা একটি যাত্রীবাহী স্পিডবোট উল্টে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শাহপরীর দ্বীপের ঘোলাচর এলাকার কাছাকাছি এই দুর্ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সেন্টমার্টিন ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ।

নিহতরা হলেন, সেন্টমার্টিনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বপাড়ার মাহফুজ রহমানের স্ত্রী মরিয়ম বেগম ও তার শিশু কন্যা মায়মা (৪)।

আব্দুর রশিদ জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে শাহপরীর দ্বীপের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া স্পিডবোটটি শাহপরীর দ্বীপের ঘোলাচর এলাকার কাছাকাছি পৌঁছালে আচমকা উল্টে যায়। এতে স্পিডবোটে থাকা আট যাত্রী সাগরে পড়ে যান। পরে সবাইকে উদ্ধার করা হলেও মরিয়ম বেগম ও তার শিশু কন্যা মায়মাকে গুরুতর অবস্থায় টেকনাফ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে দু’জনই মারা যান।