আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কর্নেল (অব:) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) যুক্ত হওয়ায় এই উদ্যোগ এখন রূপ নিয়েছে ১০ দলের একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক সমঝোতায়- যা নির্বাচনী অঙ্ক, আসন সমীকরণ এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
গতকাল রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান এই সমঝোতার ঘোষণা দেন।
সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত আমির বলেন, দেশ যখন রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন দুর্নীতিমুক্ত ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে এই দলগুলো একত্র হয়েছে। তার ভাষায়, এটি কেবল আসন ভাগাভাগির সমঝোতা নয়; বরং একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জোটটি নিজেদের প্রচলিত ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে একটি ‘নৈতিক বিকল্প শক্তি’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে- যা ভোটারদের একটি অংশের কাছে আকর্ষণ তৈরি করতে পারে। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক। সংবাদ সম্মেলনে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বীর বিক্রম, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হাক্কানী, নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল মাজেদ আতহারী, ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম চাঁন, জাগপার সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ডা: শফিকুর রহমান বলেন, দেশ যে সঙ্কটময় সময় পার করছে, সেই বাস্তবতা থেকে প্রিয় বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিতে শোষণ-বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়েই আটটি দল দীর্ঘদিন ধরে একসাথে কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আরো দু’টি দল কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বীর বিক্রমের নেতৃত্বাধীন এলডিপি এবং এনসিপি এ জোটে সম্পৃক্ত হয়েছে।
তিনি জানান, এনসিপির সাথে এরই মধ্যে বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। সময় স্বল্পতার কারণে তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে না পারলেও দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তাদের সিদ্ধান্ত আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। শিগগির এনসিপি আলাদা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে।
জামায়াত আমির বলেন, ৩০০ আসনেই নির্বাচনী সমঝোতা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়েছে এবং প্রায় সব আসনে সমঝোতা প্রায় সম্পন্ন। তিনি বলেন, আরো অনেকগুলো দল আগ্রহী ছিল। এই মুহূর্তে তাদের সম্পৃক্ত করা আমাদের জন্য খুবই দুরূহ হয়ে গেছে। অনেকের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আমরা সেভাবে তাদের সম্পৃক্ত করতে পারছি না।
তিনি আরো বলেন, এই যে সমঝোতা, এটাকে আপনারা জোট বলুন আর যাই বলুন। এটা কিন্তু জোটের চেয়েও আরো শক্ত ও মজবুত। এটা নিয়ে আমরা এগোবো।
আট দলীয় জোট আগে রাজনৈতিক ছিল। এখন যে জোট হচ্ছে সেটা কি নির্বাচনী জোট? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা দেশ গঠনের জোট। এটা নির্বাচনের, রাজনৈতিক, সব ধরনের। ভবিষ্যতের আন্দোলনও আমরা এক সাথে করব, আশা করছি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে একক কোনো দল আসন সমঝোতা করবে না। আমরা ন্যায্যতার ভিত্তিতে, সবার হাতে আসন তুলে দেবো। সবাই সবাইকে তুলে দেবে। এখানে নির্দিষ্ট কোনো দল তুলে দিচ্ছে না।
জামায়াত আমির বলেন, আমরা চাই, নির্বাচনের যে তারিখ ঘোষণা হয়েছে, তার কোনো হেরফের না হয়ে নির্বাচনটা নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠিত হোক। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখনো সবার জন্য সমতল মাঠ তৈরি হয়নি। সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। কোনো ধরনের পক্ষপাত, ভয়ভীতি বা লোভ-লালসার কাছে নতি স্বীকার করলে জাতি তা মেনে নেবে না। তিনি বলেন, বিগত কয়েকটি নির্বাচনে ভোটাধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া মেনে নেয়া হবে না। ভোটাধিকার রক্ষায় এই জোট ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করবে।
সংবাদ সম্মেলনে ডা: শফিকুর রহমান ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের স্মরণ করেন। তিনি শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনা এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।
প্রায় চূড়ান্ত আসন সমঝোতা
ডা: শফিকুর রহমান জানান, ১০ দল নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ৩০০ আসনের প্রায় সব ক’টিতে প্রার্থী নির্ধারণে একমত হয়েছে। সামান্য কিছু বিষয় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যা মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে, জোটটি নির্বাচনে প্রতীকী নয় বরং পূর্ণাঙ্গ ও সংগঠিত প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এনসিপির যুক্ত হওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ
এনসিপি তুলনামূলক নতুন রাজনৈতিক দল হলেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় এটি একটি সক্রিয় নাগরিক শক্তি হিসেবে আলোচনায় এসেছে। দলটির যুক্ত হওয়া জামায়াতকেন্দ্রিক জোটকে শুধু আদর্শিক নয় বরং নাগরিক ও মধ্যবিত্ত রাজনীতির সাথে সংযোগ ঘটানোর সুযোগ দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যদিও এনসিপির নেতারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না, তবে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সরাসরি জোট নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন বলে জানানো হয়। এনসিপি নিজেদের অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে।
নির্বাচন নিয়ে কড়া সতর্কবার্তা
নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেড় মাসেরও কম সময় হাতে রয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের আমির সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এখনো সব দলের জন্য সমতল মাঠ তৈরি হয়নি এবং অতীতের মতো ভোটাধিকার হরণ হলে তা মেনে নেয়া হবে না। এই বক্তব্যকে বিশ্লেষকরা নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তেজনার ইঙ্গিত হিসেবেও দেখছেন।
জোটের ভবিষ্যৎ রাজনীতি
এই উদ্যোগকে কেবল ‘নির্বাচনী জোট’ হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না জোট নেতারা। তাদের দাবি, জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে ভবিষ্যতেও তারা একসাথে আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করবেন।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, জামায়াত-এনসিপি-এলডিপিসহ ১০ দলের এই সমঝোতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ধারার জোট রাজনীতির সূচনা করতে পারে, যা ভবিষ্যতে সংসদের ভেতরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলবে।



