বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের গভীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক

মেজর নাসিরের বক্তব্য- ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পরবর্তী ১২-১৫ বছরের মধ্যে নৈতিকভাবে দাঁড়াতে না দেয়াই ছিল তাদের পরিকল্পনা।’

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের গভীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের গভীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক

পিলখানা ম্যাসাকার নিয়ে গঠিত স্বাধীন তদন্ত কমিশন বিভিন্ন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ তথ্য, সাক্ষ্য, বিদেশী প্রকাশনা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণ করে অনুসিদ্ধান্তে এসেছে- ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এর বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের সম্ভাব্য গভীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক ও তদন্ত-উপযোগী। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- এই বিডিআর বিদ্রোহ- বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ও রহস্যঘেরা হত্যাযজ্ঞ। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন, প্রত্যক্ষদর্শী, সামরিক কর্মকর্তা, নিহত অফিসারদের পরিবারের সদস্য এবং বিদেশী রিসার্চভিত্তিক প্রকাশনাসহ বহু উৎসে ভারতের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার অসংখ্য ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঘটনা-পরম্পরার গভীরে গেলে উঠে আসে বিদেশী যোগাযোগ, সন্দেহজনক আগমন-বহির্গমন, ভারতীয় সংস্থার উপস্থিতি, কূটনৈতিক তৎপরতা ও সীমান্তে সেনাসমাবেশের মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য।

বিদেশে ‘র’-এর সাথে বৈঠক ও সেনাবাহিনী দুর্বল করার অভিযোগ : ২০০৮ সালের জুনে মেজর নাসির উদ্দিন (বিএ-১১৮৩৮) বরিশালে ডিজিএফআই কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুস সালামকে জানান, তিনি বিদেশ সফর শেষে একই বিমানে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে দেখতে পান। অভিযোগ অনুযায়ী, ওই নেতারা ভারতের বারাসাতে ‘র’-এর সাথে বৈঠক শেষে ফিরছিলেন। বৈঠকে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহসহ অন্যরাও ছিলেন বলে তিনি দাবি করেন।

মেজর নাসিরের বক্তব্য- ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পরবর্তী ১২-১৫ বছরের মধ্যে নৈতিকভাবে দাঁড়াতে না দেয়াই ছিল তাদের পরিকল্পনা।’

ভারতীয় উচ্চকমিশন কর্মকর্তার বক্তব্য : ‘পাদুয়া চ্যালেঞ্জমুক্ত থাকবে না’: ২০০৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরা মেজর (অব:) নাসির ভারতীয় ভিসার জন্য ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে গেলে তার সাথে সাক্ষাৎ হয় কর্মকর্তা নিরাজ শ্রীবাস্তবের। শ্রীবাস্তব বাংলাদেশ বাহিনীকে পাকিস্তানঘেঁষা আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘পাদুয়া চ্যালেঞ্জ এবং শাস্তির বাইরে থাকবে না।’

পাদুয়া সীমান্তে ১৬-১৭ জন বিএসএফ সদস্য নিহতের ঘটনায় ভারত প্রতিশোধ নেবে-এমন প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত তিনি দেন।

তোরাব আলীর বয়ান : ভারতীয়দের সাথে বৈঠক ও তাপসের বাসায় চূড়ান্ত পরিকল্পনা : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নায়েক শহীদুর রহমান জানান, তোরাব আলীর মাধ্যমে তিনি শোনেন যে ভারতীয়দের সাথে বৈঠকের পর পুরো পরিকল্পনা সাজানো হয়। এরপর শেখ ফজলে নূর তাপসের বাসায় সমন্বয় বৈঠক হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন নানক, মির্জা আজম, তাপস, শেখ সেলিম, লেদার লিটন ও তোরাব আলী।

বৈঠকে যখন জানানো হয় অফিসারদের হত্যা করা হবে, তোরাব আলী তাতে আপত্তি জানান বলে অভিযোগ।

পিলখানায় ‘র’ সদস্যদের দেখা যাওয়ার দাবি : ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯:৪৫-১০:০০টার মধ্যে সাবেক এমপি গোলাম রেজা দাবি করেন, নর্দার্ন মেডিক্যাল কলেজের কাছে তিনি ‘র’-এর চার-পাঁচজন কর্মকর্তাকে দেখেছেন। তার সাথে ছিলেন আলাউদ্দিন নাসিম, সাবেক এমপি মোর্শেদ ও শেখ সেলিম।

ভারতীয় এনএসজির উপস্থিতির অভিযোগ : ক্যাপ্টেন তানভীর হায়দার নূরের স্ত্রী তাসনুভা মাহা জানান, বিদ্রোহ চলাকালে মোবাইলে কথা বলার সময় ক্যাপ্টেন তানভীর তাকে বলেন, ‘পিলখানার ভেতরে ভারতীয় সংস্থা এনএসজি উপস্থিত।’ এ ছাড়া তিনি তিনজন লম্বা চুলওয়ালা, বিডিআরটির শার্ট-স্যান্ডেল পরা লোককে দেখেন যারা তাকে হিন্দিতে গালিগালাজ করে ‘পাকিস্তানি লাডলা’ বলে।

পিলখানায় হিন্দি, পশ্চিমবঙ্গীয় উচ্চারণ ও অচেনা ভাষা : নানান প্রত্যক্ষদর্শী, নায়েক শহীদ, সিপাহি সেলিম, মসজিদের ইমাম মরহুম সিদ্দিকুর রহমান, সিপাহি শাহাদাত, তাসনুভা মাহা পিলখানার ভেতরে ২৫ তারিখ সশস্ত্র বহিরাগতদের দেখেন। কারো ভাষা ছিল হিন্দি, কেউ পশ্চিমবঙ্গের টানে বাংলা, আবার কেউ সম্পূর্ণ অচেনা ভাষায় কথা বলছিল।

বিদেশী ধাঁচের সামরিক সরঞ্জাম : ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুসন্ধান এবং উদ্ধার অপারেশনে অংশ নিয়ে ক্যাপ্টেন শাহনাজ দরবার হলের কাছে একটি বিদেশী স্লিংযুক্ত সাব-মেশিনগান দেখতে পান। স্লিংয়ে ইংরেজিতে বড় অক্ষরে লেখা- টাইগার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বা বিডিআর এ ধরনের স্লিং ব্যবহার করে না।

সন্দেহজনক গাড়ি বহর : ইংরেজিতে কথা বলা মুখঢাকা ব্যক্তিরা : ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১০:৩০-১১টার দিকে পিলখানার গেট খুলে কয়েকটি মাইক্রোবাস বেরিয়ে যায়। লে. কর্নেল রওশনুল ফিরোজ নিজ চোখে দেখেন- একটি মাইক্রোবাসে ৬-৭ জন মুখঢাকা, বিদেশী উচ্চারণে ইংরেজিতে কথা বলা, সুগঠিত, সামরিক ধাঁচের লোক বসে আছে।

ভারত ও সিঙ্গাপুরে ফোন যোগাযোগ : তোরাব আলীর মোবাইলফোনে ভারত ও সিঙ্গাপুরে একাধিকবার কল যেত- এমন তথ্য সিডিআর বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। ভারতীয় হাইকমিশনকে চিঠি দিয়েও গ্রাহক পরিচয় পাওয়া যায়নি।

সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য সমাবেশ ও উদ্ধার অভিযান প্রস্তুতির স্বীকারোক্তি

সাবেক সিজিএস লে. জেনারেল সিনা ইবনে জামালী জানান, ১১ ডিভিশন জিওসির কাছ থেকে তিনি খবর পান ভারত সীমান্তে সৈন্য ও প্যারাট্রুপার সমাবেশ করছে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে তারা শেখ হাসিনাকে ‘উদ্ধার’ করবে।

সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সাক্ষ্যে বলেন- সশস্ত্রবাহিনী সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাবে- এমন খবর তিনি পাচ্ছিলেন।

শেখ হাসিনার এসওএস কল ও ভারতের প্রতিক্রিয়াও তাৎপর্যপূর্ণ। বিদ্রোহ শুরুর পরপরই শেখ হাসিনা ফোন করেন ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে। প্রণব আশ্বাস দেন, ‘সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে।’

পররাষ্ট্রসচিব শিবশংকর মেনন যুক্তরাজ্য, চীন, জাপানকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য জড়িত হন।

গবেষক অভিনাশ পালিওয়ালের বইয়ে ভারতীয় অভিযান প্রস্তুতির স্বীকারোক্তিও এর সমর্থন করে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত

‘ইন্ডিয়াস নিয়ার ইস্ট : এ নিউ হিস্টরি (২০২৪)-এর ২৮৬-২৮৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ভারত প্যারাট্রুপার তিন দিক থেকে ঢোকার প্রস্তুতি নেয়- কালাইকুন্ডা, জোরহাট, আগরতলা। লক্ষ্য ছিল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও তেজগাঁও দখল করে গণভবন নিয়ন্ত্রণে নেয়া এবং শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করা।

ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী স্বীকার করেন ‘আমরা কিছু বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম।’

বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মো: তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘জেনারেল মইনকে বলপ্রয়োগ না করার জন্য বলা হয়েছিল, অন্যথায় ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা এক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় নেমে আসবে।’ জাতীয় তদন্ত কমিশনের লিখিত প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

ভারতীয় নাগরিকদের অস্বাভাবিক যাতায়াত (২৪-২৭ ফেব্রুয়ারি): বাংলাদেশ পুলিশ ইমিগ্রেশন প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী- ৮২৭ জন ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে, এর মধ্যে ৬৫ জন আদৌ বের হয়েছে কি না তার রেকর্ড নেই। ১২২১ জন ভারতীয় বাংলাদেশ ত্যাগ করে, যাদের মধ্যে ৫৭ জনের প্রবেশের রেকর্ড নেই। সংখ্যা ও সময়-দু’টিই অস্বাভাবিক।

বিডিআরকে বিদেশী সহায়তায় পুনর্গঠনের সরকারি সিগন্যালও গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ ঘোষণা দেন- বিডিআরকে পুনর্গঠন ও উন্নয়নে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের সহায়তা নেয়া যেতে পারে।

কেন ভারতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে : এই ঘটনাগুলো স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল- ১. বিডিআর নেতৃত্বশূন্য ও সেনাবাহিনী দুর্বল করার লক্ষ্য এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় ভারত। ২. ২০০১ সালের পাদুয়া সংঘর্ষে বিএসএফের বড় পরাজয়ের প্রতিশোধমূলক মনোভাব ৩. ভারতের উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক-সামরিক তৎপরতা ৪. পিলখানায় ভারতীয় এনএসজি/র’ এর সম্ভাব্য উপস্থিতি ৫. সন্দেহজনক বিদেশী সেনাধাঁচের ব্যক্তিদের দেখা যাওয়া ৬. ভারতীয় নাগরিকদের অস্বাভাবিক সংখ্যা প্রবেশ-বহির্গমন ৭. গবেষণাভিত্তিক বইয়ে ভারতীয় কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি যে ‘ভারত প্যারাট্রুপার মোতায়েন করেছিল।’

সব মিলিয়ে, বিভিন্ন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ তথ্য, সাক্ষ্য, বিদেশী প্রকাশনা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণ-সবই ইঙ্গিত করে যে ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এর বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের সম্ভাব্য গভীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক ও তদন্ত-উপযোগী।