- সিলেটে টিলার পাদদেশে ৫০০ পরিবারের বাস
- বাড়ছে নদী ও হাওরের পানি
- বান্দরবানে ২৫ পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ
সিলেটের গোলাপগঞ্জে অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধসে স্বামী-স্ত্রীসহ একই পরিবারের চারজন ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হয়েছে। এ ছাড়া জেলার ১১টি স্থানের পাহাড় ও টিলার পাদদেশে পাঁচ শতাধিক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। সুনামগঞ্জের হাওরের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকটি বাঁধ ভেঙে হাওর এলাকায় ফসলের ক্ষেত বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। এ দিকে ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার সীমান্তবর্তী ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বান্দরবানে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় স্থানীয় ২৫টি পর্যটক কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
সিলেট ব্যুরো ও গোলাপগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, সিলেটের গোলাপগঞ্জে অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ধসে স্বামী-স্ত্রীসহ একই পরিবারের চারজনের ঘুমন্ত অবস্থায় মাটিচাপায় মৃত্যু হয়েছে। শনিবার দিনগত রাত ৩টার দিকে উপজেলার লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের বখতিয়ারঘাট গ্রামে এই দুর্ঘটনা ঘটে। সংবাদ পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী টিম ও গোলাপগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রায় দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা ভারী বর্ষণের মধ্যে চেষ্টা চালিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতরা হলেন মৃত আসিদ আলীর ছেলে মো: রিয়াজ উদ্দিন (৫৫), স্ত্রী রহিমা বেগম (৪০), মেয়ে সামিয়া খাতুন (১৪) ও ছেলে আব্বাস আলী (৯)।
গতকাল রোববার ভোরে টিলাধসে নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোলাপগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুজ্জামান মোল্ল্যা। পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
এ দিকে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা, লক্ষ্মীপাশা, গোলাপগঞ্জ পৌরসভা, ঢাকা দক্ষিণ, ভাদেশ্বর, লক্ষণাবন্দ, আমুড়া, গোলাপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল, চারিকাটা, সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়নে পাহাড় ও টিলার পাদদেশে পাঁচ শতাধিক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে। শনিবার রাতে লক্ষণাবন্দে একই পরিবারের চারজন নিহত হওয়া ছাড়াও উপজেলার আমুড়া ইউনিয়নে তিনটি বাড়ি ও ঘোষগাঁও গ্রামে একটি বাড়ি টিলাধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। এ দিকে গত বছরেরর জুনে সিলেট নগরীর চামেলীভাগ এলাকায় ভারী বৃষ্টিতে টিলা ধসে একই পরিবারের তিনজন মারা যান। এর আগে ২০২২ সালে ৬ জুন জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নে সাতজনি গ্রামে টিলাধসে একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়। এ সময় আরো পাঁচজন গুরুতর আহত হন।
রোববার ভোরে গোলাপগঞ্জে দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে সকালেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। তিনি নিহত পরিবারের দাফন কাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার অনুদান দেন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ নয়া দিগন্তকে জানান, পাহাড়-টিলার নিচের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়ার জন্য সময় সময় উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রতিটি এলাকায় সতর্কতা অবলম্বন করতে প্রচারণা চালানো হয়েছে। পাহাড় টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারদের চিহ্নিত করে বারবার তাগিদ দেয়া হলেও মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র যেতে চায় না। এভাবে পাহাড়ধসে ফের যেন মৃত্যুর ঘটনা না ঘটে এ জন্য পাদদেশে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বিপদসীমা ছাড়াল সুরমা-কুশিয়ারার পানি : গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ৪০৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে; যা চলতি বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সিলেটের সব ক’টি নদ-নদীতে বানের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে দু’টি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার পানি বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এ ছাড়া টানা বর্ষণের কারণে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা যেন থামছেই না। শনিবারের মতো গতকাল রোববার সকালেও নগরীর অধিকাংশ রাস্তাঘাট জলে মগ্ন হয়ে পড়ে। বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে ঢুকেছে পানি।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বেলা ৩টা পর্যন্ত সিলেটের সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৫৮ মিটারে অবস্থান করছিল, যা বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৮৩ মিটার ওপরে। এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে ১৬ দশমিক ৮৩ মিটারে অবস্থান করছিল, যা বিপদসীমার ১ দশমিক ৪৩ মিটার ওপরে। শেওলা পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি ১৩ দশমিক ২২ মিটারে অবস্থান করছিল, যা বিপদসীমার শূন্য দশমিক ১৭ মিটার ওপরে। ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টেও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে অতিক্রম করেছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদী ছাড়াও জেলার লোভা, সারি-গোয়াইন ও ধলাইসহ সব ক’টি নদ-নদীর পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সারি ও ডাউকি নদীর পানি শনিবারের চেয়ে সামান্য কমেছে। এ দিকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় গত শনিবারের মতো রোববারও সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। নগরের উপশহর, চৌকিদেখি, মেজরটিলা, মিরাবাজার, যতরপুর, সাগরদিঘিরপারসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমা হতে দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার অনেক বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি ঢুকেছে। তবে বেলা ১টা নাগাদ বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসায় বিভিন্ন এলাকার পানি নেমে যেতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলার নিম্নাঞ্চলে দ্রুত পানি বাড়ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এ ব্যাপারে সিলেট আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো: সজীব হোসাইন জানান, শনিবার সকাল ৬টা থেকে রোববার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ৪০৪ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টির হিসাবে চলতি বছর এটাই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড।
এ দিকে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলার ১৩টি উপজেলায় ৫৮২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। তিনি বলেন, বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জকিগঞ্জের কুশিয়ারায় নদীর বেড়িবাঁধে ফাটল
জকিগঞ্জ (সিলেট) সংবাদদাতা জানান, সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদীর বেড়িবাঁধ ধসে ৪টি স্থানে ভয়ঙ্কর ফাটল দেখা দিয়েছে। গতকাল রোববার (১ জুন) সন্ধ্যা পর্যন্ত জকিগঞ্জ পৌরসভার মাইজকান্দি, বীরশ্রী ইউপির গদাধর, লক্ষীবাজার ও জকিগঞ্জ সদর ইউপির মানিকপুর এলাকায় বেড়িবাঁধে ফাটল ধরার খবর পাওয়া গেছে। ভাঙন আতঙ্কে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী শনিবার নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
স্থানীয়রা জানান, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকেই জকিগঞ্জ উপজেলাবাসী সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ভাঙনের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। তবুও কেউ জনগুরুত্বপূর্ণ এই সমস্যার সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। বছরের পর বছর এমপি, মন্ত্রী ও চেয়ারম্যানদের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে জকিগঞ্জবাসীর গুরুত্বপূর্ণ এ দাবি। ২০২২ ও ২০২৪ সালে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পুরো সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে নড়েচড়ে ওঠেন জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও রাজনৈতিক নেতারা।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত দিনে একের পর এক বন্যা ও বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়ে ঘরবাড়ি-সহায় সম্পদহারা হয়ে চরমভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন জকিগঞ্জ উপজেলার অসংখ্য পরিবার। চলতি বর্ষায় ফের ভাঙনের শিকার হলে এলাকার হাজার হাজার মানুষ চরম বিপাকে পড়বে। এ ব্যাপারে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো: মাহবুবুর রহমান বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দেয়ায় আমরা তাৎক্ষণিক পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করেছি। রোববার আমলশীদ বরাক মোহনা ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। বন্যা মোকাবেলায় আমরা উপজেলায় বন্যা কন্ট্রোল রুম চালু করেছি এবং ৫৭টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছি।
সুনামগঞ্জে বাড়ছে নদী ও হাওরের পানি
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জে কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ও ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলে জেলার সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, বৌলাই, ধনু নদীসহ সব কয়টি নদ-নদীর পানি বেড়েছে। হাওর ভরে টইটুম্বুর হয়ে গেছে।
মেঘালয়ে অতি ভারী বৃষ্টিপাতে জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার খাসিয়ামারা- চিলাই নদী, ছাতক উপজেলার চেলা ও পিয়াইন নদী, মধ্যনগর উপজেলার সোমেশ্বরী, তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা, মাহারাম, পাটলাই ও বৌলাই নদী, জামালগঞ্জের সুরমার ও রক্তি নদী, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মরা যাদুকাটা নদীতে বেগে পাহাড়ি ঢল নামায় জেলার নিম্নাঞ্চলে বাড়ছে পানি। ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে তাহিরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু গ্রাম। হাওরের ফসল রক্ষা কয়েকটি বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, মধ্যনগর, দিরাই-শাল্লা সহ জেলার বিভিন্ন হাওরে পানি বাড়ছে।
আগামী দুই দিন ভারী থেকে অতিভারী ও পরবর্তী দিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, মধ্যনগর উপজেলার নদী ও হাওরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো ঝড়ো হাওয়া ও ঢেউয়ের আঘাতের মুখে পড়েছে। হাওরগুলো পানিতে পরিপূর্ণ হচ্ছে। পানির চাপে তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের বড়দল নতুন হাটি গ্রামের পাশের একটি বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ডা: মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, এখনো বন্যার তেমন আভাস নেই। বন্যা হলে ‘বন্যা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি আছে। জেলার সব উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে আশ্রয় কেন্দ্র তাৎক্ষণিক খুলে দেয়া হবে।
নেত্রকোনায় পাহাড়ি ঢলে বন্যার আশঙ্কা
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনা জেলার নিমাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলার প্রধান পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী, কংশ, উব্দাখালী, ধনু, মগড়াসহ বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে টইটম্বুর হয়ে উঠেছে। সুনামগঞ্জ জেলা হয়ে নেত্রকোনার হাওরের উপর দিয়ে প্রবাহিত ধনু নদ, সীমান্তের উব্দাখালী, কংশ নদ ও মগড়া নদীর পানি এখন বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অতিবর্ষণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে পড়েছে। জেলার অধিকাংশ অঞ্চলের নিম্ন আয়ের নারী-পুরুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়ায় আয়, রোজগারের অভাবে অনেকে বিপাকে পড়েছেন। ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন বিপণিবিতানে আশানুরূপ ক্রেতা সাধারণের অভাবে দোকানিদের মাঝে হতাশার ছাপ দেখা দিয়েছে।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারওয়ার জাহান বলেন, প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সোমেশ^রী, কংশ নদের চেয়েও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে পাহাড়ি নদী উব্দাখালী।
আখাউড়ায় সীমান্তবর্তী ২৫ গ্রাম প্লাবিত
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি ও আখাউড়া সংবাদদাতা জানান, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর এলাকার আশপাশের সীমান্তবর্তী ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, স্থলবন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কলন্দিখাল, কালিকাপুর হয়ে আব্দুল্লাপুর দিয়ে জাজি গাং, বাউতলার মরা গাং ও মোগড়া ইউনিয়নের হাওড়া নদী দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে পানি ঢোকার কারণে তলিয়ে যাচ্ছে ওইসব গ্রামের রাস্তাঘাট। এতে করে উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের কালিকাপুর, বীরচন্দ্রপুর, আব্দুল্লাহপুর ও বঙ্গেরচর গ্রামের জমি ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গতরাত থেকে এসব নদী, খাল দিয়ে পানি ঢুকছে। এতে করে এসব গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মনজুর রহমান বলেন, হাওড়া নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০/৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
পানি বেড়েছে তিস্তায়
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, গত শনিবার রাতে নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদ সীমার (৫২.১৫) ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে গতকাল রোববার পানি কিছু নেমে বেলা ৩টায় বিপদসীমার দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার (৫১.৮০) নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।
সূত্রমতে, তিস্তার উজানে ভারতের গজলডোবা পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছিল ১২০ সেন্টিমিটার। বর্তমানে সেখানে পানি কমতে শুরু করেছে। একই সময়ে দো-মহনী পয়েন্টে পানি বেড়েছিল ৬১ সেন্টিমিটার। রাত ৯টায় এ পয়েন্টে পানি সমতল ছিল ৮৫ দশমিক ৬৩ মিটার, যা বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার নিচে। এদিকে ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার ডালিয়া পয়েন্টে ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান তিস্তার পানি একই লেবেলে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে উজানের ঢলের রেশ রয়েছে। কারণ সকাল ৬টা ও সকাল ৯টায় পানি কমলেও দুপুর ১২টা ও বেলা ৩টায় পানির লেবেল একই গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে।
রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে পাহাড় ধস, জমি প্লাবিত
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, রাঙ্গামাটিতে গত কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসে সড়ক যোগাযোগ বিঘ্ন ঘটেছে এবং কাপ্তাই হ্রদে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জুরাছড়ি উপজেলায় দু’টি স্কুল, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। গতকাল পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটি- চট্টগ্রাম সড়কের সাপছড়ি, কলাবাগানসহ বিভিন্ন স্থানে মাটি ভেঙে পড়ায় সড়ক যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।
সড়ক বিভাগের কর্মীরা রাস্তায় পাহাড়ের ভেঙে পড়া মাটি সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করে। গত কয়েকদিনে থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। এতে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় রাঙ্গামাটি শহরের দু’টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১৪১ জন আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
বরগুনায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, বরগুনা উপকূলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাঙা ১৩ পয়েন্টের ৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আজও সংস্কার হয়নি। জেলার সদর, আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, বেতাগী ও বামনার ছয় উপজেলার ১৩ পয়েন্টের বেড়িবাঁধ ভাঙা বেড়িবাঁধ থেকে আমাবস্যার জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত তিন দিনের বিরামহীন বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ থেকে জোয়ারের পানি ঢুকে এ এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে, বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় রেমালে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছিল ১১০০ মিটার বেড়িবাঁধ। এর আগে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরে বরগুনার বিভিন্ন এলাকার প্রায় সাড়ে ৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে বরগুনার নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। এতে সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের ডালভাঙা এলাকার একটি রিং বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামটির কিছু অংশ প্লাবিত হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে অন্তত ২০০টি পরিবার।
সরেজমিন দেখা যায়, বিষখালী নদীর পানি বুধবার রাত থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত ৪ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ওই এলাকার একটি রিং বেড়িবাঁধের কিছু অংশ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল বলেন, আমরা রিং বেড়িবাঁধ উপচে পানি প্রবেশের কথা জেনেছি । জেলা প্রশাসন এসব এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার আশ্রয়ণ কেন্দ্র খোলা রাখা হয়েছে। আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি, বৃষ্টি কমে গেলে ও অমাবস্যার জোয়ারের পানি কমবে।
সিডিএসপি বাঁধ তলিয়ে গেছে
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে টানা ভারী বর্ষণ ও ফেনী নদীর জোয়ারের স্রোতে সিডিএসপি বাঁধ তলিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ওই এলাকায় নদীভাঙনে প্রায় ২০০ একর মৎস্য খামার সম্পূর্ণভাবে নদীতে হারিয়ে গেছে। ঝুঁঁকিতে রয়েছে আরো অন্তত ৫০০ একর প্রকল্প। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকূলাঞ্চলের চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্টের (সিডিএসপি) আওতায় নির্মিত ১১.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাঁধের একাধিক অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছিল পূর্বেই। টানা দু’দিনের টানা বর্ষণের কারণে সেই বাঁধের প্রায় অংশই এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
উপজেলার মুহুরী প্রকল্পের নিম্নাঞ্চলের ইছাখালী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও মৎস্য খামার মালিকেরা জানান, উপকূলীয় বাঁধ রক্ষায় অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে মিরসরাইয়ে গড়ে ওঠা ৩৪ হাজার একরের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিইজেড) এলাকা ও হুমকির মুখে পড়বে। একই সাথে বাঁধ ভেঙে গেলে লবণাক্ত পানি ঢুকে উপজেলার ৫ নম্বর ওচমানপুর ও ৬ নম্বর ইছাখালী ইউনিয়নের ১০১২টি গ্রামে দেখা দিতে পারে জলাবদ্ধতা ও বন্যা। মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোমাইয়া আক্তার বলেন, বাঁধরক্ষায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছে।
কুলাউড়ায় মনু ও গোগালীছড়ায় বাঁধে ভাঙন
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা জানান, অতি ভারী বর্ষণে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার মনু ও গোগালীছড়ায় দু’টি বাঁধ ভেঙে বিস্তির্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পৌর এলাকার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় জয়পাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ ছাড়াও কুলাউড়া-বড়লেখা সড়কের লোয়াইউনি এলাকায় টিলা ধসে রাস্তায় পড়ে যানবাহন চলাচল বিঘি্ণত হচ্ছে।
কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ জানান, পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শালিকা এলাকায় একটি কালভার্টের জন্য সড়ক বিভাগ রাস্তা কেটেছিল। এখন মনু নদীর পানি ভেড়ে তা ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে।
লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, গত ক’দিনের টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর পানি হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। এতে করে তিস্তা পাড়ের মানুষজন বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা করছে। যেকোনো সময় তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করছে। ফলে পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
গতকাল তিস্তার পানি সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ দশমিক ৮৬ মিটার, যা বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে গত শনিবার বিকেল ৩টায় পানি উচ্চতা রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ২৭ সেন্টিমিটার। এ দিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ৮-১০টি চর এলাকায় পানি উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়াও লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা, রাজপুর, খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন এবং আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ও গোর্বধন এলাকার নিম্নাঞ্চল পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার বলেন, উজানে ভারতের সিকিম ও ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে তিস্তার পানি হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করেছে। পানি এখনো বিপদসীমার নিচে আছে, তবুও আমরা সতর্ক আছি।
বান্দরবানে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় ৬০ পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ
বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কায় বান্দরবানের লামা উপজেলায় ৬০টি পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। উপজেলার মিরিঞ্জা রেঞ্জ ও শুখিয়া দুখিয়া ভ্যালিতে অবস্থিত এসব পর্যটন কেন্দ্র আজ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গতকাল দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এক জরুরি বৈঠক শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ নির্দেশনা জারি করেছেন। লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মইন উদ্দিন জানিয়েছেন টানা ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে ও পর্যটকদের জীবন রক্ষায় উপজেলার তিনটি স্থানের ৬০টি পর্যটনকেন্দ্র পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্যটকরা যাতে এই বৈরী আবহাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যেতে ও রাত্রি যাপন করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।