বাংলাদেশে গুম-খুনের সাথে সম্পৃক্ততা ভারতীয়দের

“টাকার অভাবে শুধু পানি পান করতাম। সেখানে ৪ দিন বাসস্ট্যান্ডে থাকার পর লোকজন আমাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।”

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition

আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা তার মত বিরোধীদের গত ১৬ বছর শুধু নির্যাতন-নিপীড়ন গুম-খুনই করেননি বাংলাদেশের গুম-খুনের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকেও এই কাজে যুক্ত করেছেন। ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতার নামে আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবিরোধীর আখ্যান দিয়ে নিরাপত্তার নামে যৌথ অভিযান, সীমান্তে পারস্পরিক সমন্বয় এবং অবৈধভাবে আত্মসমর্পণে রূপান্তরিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। গুম কমিশনের রিপোর্টে বেশ কয়েকটি সাক্ষ্যে গুমের শিকার কয়েকজন ভারতীয় হেফাজত থেকে বাংলাদেশী গোয়েন্দাদের কাছে হস্তান্তরের বর্ণনা দিয়েছেন। বর্ণনায় ফুটে উঠেছে ভারতীয় গোয়েন্দারা ভুক্তভোগীদের কিভাবে বছরের পর বছর নিখোঁজ রেখে নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক কথা আদায়ের চেষ্টা করত।

গুম কমিশন সূত্র জানায়, একটি ঘটনায় ভারতীয় গোয়েন্দারা প্রথমে এক ব্যক্তিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ডিজিএফআই ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠায়। তারা বন্দীকে প্রশ্ন করে এবং উত্তরগুলো ডিজিএফআইকে ফেরত পাঠায়।

পরে ওই ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয় এবং ডিজিএফআই হেফাজতে স্থানান্তর করা হয় যেখানে তাকে বছরের পর বছর ধরে জোরপূর্বক নিখোঁজ রাখা হয়। বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে তার হস্তান্তরের ঘটনা বর্ণনা করেছেন ওই ব্যক্তি। তিনি কমিশনকে জানান, ‘রাতের বেলায়, রাত তখন দেড়টা। ভারতের এক অফিসার প্রথমে আমার চোখ বাঁধলো। হ্যান্ডকাফ তো আছেই। এরই মধ্যে তারা অস্ত্রসহ রেডি হলো। তারপর গাড়ি থেকে ১০ মিনিট পরে নামানো হলো। গাড়ি থেকে নামানোর পর বুঝলাম যে, আমাকে ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। তখন আমাকে অফিসার বলছে ‘ তুমি বস, তুই বস’। ওই ভুক্তভোগী বলেন, আমাকে বসিয়ে নিচ দিয়ে পার করেছে।

আরেকজন ভুক্তভোগী বলেন, যাকে আমরা র‌্যাব সূত্র থেকে নিশ্চিত করতে পেরেছি, তাকে র‌্যাবের গোয়েন্দাদের পরিচালিত দু’টি আয়নাঘরে আটক রাখা হয়েছিল, ওই ভুক্তভোগী বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। যেখানে পরে তাকে ভারতীয় মুসলিমদের ওপর ভিডিও পোস্ট করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।

আরেক ভুক্তভোগী ২১ বছর বয়সী পুরুষ; ২০১৬ সালে ডিজিএফআই, র‌্যাব গোয়েন্দা এবং র‌্যাব ১ কর্তৃক অপহরণের পর ২ বছর ৮ মাস ৭ দিন নিখোঁজ ছিলেন। আরেক ব্যক্তি ২০২৩ সালে র‌্যাব ৪ এবং র‌্যাব গোয়েন্দা কর্তৃক অপহরণের পর ১ বছর ৩ মাস ২৪ দিন গুম করে রাখা হয়।

তারা বলেন, র‌্যাব আমাদের একই জায়গায় ৩ মাস রাখে। ভুক্তভোগীরা বলেন, গুম করে তারা নিয়ে যাওয়র পর বলেন, অনেক বড় বড় গোয়েন্দা সংস্থা আছে , আমাদের হাত থেকে (র‌্যাব) নিয়ে তোকে মাইরা ফেলবে।

আমার কাছে এত দিন ছিলি, তোর ভালোর জন্য দেশের বাইরে কিছুদিন রাখতে চাই। তোমার আম্মা অনেক কান্নাকাটি করছে, এর জন্য অনেক ছাড়াছাড়ি হয়েছে। তাই তোমাকে ইন্ডিয়া পাঠাবো।

এরপরের দিনই তাকে হাইস গাড়িতে চোখ বেঁধে নিয়ে গেল। বর্ডারে মোটরসাইকেলে করে দুইটা লোক আসে। বলল এরা তোকে পার করবে। সেখানে (ভারতে) কয়দিন থাকবি আমরা তোকে আবার নিয়ে আসবো। ভুক্তভোগী বলেন, যখন আমাকে আরেক জনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তখন আমার চোখ খোলা। তাদের দেখলাম, নদী পার করা হলো। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আমাকে তারা নিয়ে গেল ভারতে। এরপর একটা বাসে তুলে দিয়ে তারা বলে, এই বাস যেখানে গিয়ে থামবে সেখানেই নেমে পড়বি।

আমি নামার পর দেখি কেউ আসে না। রাত হয়ে যায়, বাংলাদেশ থেকে তিন হাজার টাকা দিয়েছে ওই টাকাও যারা বাসে তুলে দেয় তারা নিয়ে যায়। পরে এক হাজার ইন্ডিয়ান মুদ্রা দিয়ে যায়। টাকার অভাবে শুধু পানি পান করতাম। সেখানে ৪ দিন বাসস্ট্যান্ডে থাকার পর লোকজন আমাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ধরে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। বিস্তারিত বলার পর ভারতের পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস না করে ‘আনপাসপোর্ট’ কেস দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়।

ভারতের পুলিশ জেলে পাঠানোর পর সেখানেও দুটো টয়লেটের মাঝখানে-মানে টয়লেটের যেটা নোংরা, ওইগুলার মাঝখানে শুয়ে থাকতে দিতেন। আবার দোতালার পাইপের ওপর, ভাঙা টয়লেটে, ওই জায়গা থেকে ছিটা ছিটা আইতো শরীরের ওপর। ওই জায়গায় শোয়াইতো। আবার খাবার-কখনো দিত, কখনো দিত না। কাজ করাইতো, কাজ কইরা দেখতাম খাবার নাই।

গুমের শিকার ওই ব্যক্তি বলেন, দিল্লি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লোক আইছে। তারা বলল, আমরা দিল্লি হেডকোয়ার্টার থেকে আইছি। তোরে আইসা জিজ্ঞাসাবাদ করবে, ‘তুই কিসের জন্য ইন্ডিয়াবিরোধী ভিডিও ছাড়ছিস? আমি বললাম, আমি জানি না, আর আমি কিছু ছাড়ি নাই। তখন তারা বাংলা বলছে। ভারতবিরোধী ভিডিও কিসের জন্য পোস্ট করতাছি, বিশেষ করে কাশ্মিরিবিরোধী ভিডিও। মানে মুসলমানদের একটু জুলুম হইতেছে না, ওইটার পক্ষে কিছু বলা হইছে। তারা জিজ্ঞাসা করছে ইন্ডিয়ার প্রসঙ্গে। তারা বলল, এই ভুল জানি আর জীবনে করবা না। এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। এরকম। না, এমনে টর্চার করে নাই। কিন্তু ওই যে খাবারে সমস্যা করছিল-খাইবার দেয় নাই। কাজ করাইছে, কিন্তু খাইবার দেয় নাই।

প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা হইতো। শরীর প্রচুর দুর্বল হয়ে গেছে। তখন গুমখানায় ডিউটি করা একটু অফিসার পর্যায়ের একজন কয়, তুমি নিজেকে নিজে মাইরে ফেলাইতোছো কেন? তুমি জানো নেলসন ম্যান্ডেলা কত বছর জেল খাটছে? তারাই আবার আমারে বুঝাইতো, ইউসুফ নবী অনেক জেল খাটছে, ইয়া খাটছে, এগুলো তারাই বুঝাইতো।

পরে যখন আমি হাঙ্গার স্ট্রাইক দিলাম, আমি বড় স্যারদের সাথে কথা বলতে চাই। পরে একজন বড় স্যার-উ আমাকে সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন এবং সর্বশেষও উনি জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন তার মনে একটু কিঞ্চিৎ হয়তো মানুষের ছোঁয়া আছে।

প্রচণ্ড খারাপ লোক সবাই, কোনো সন্দেহ নাই। তো আমি বলতেছি, ‘স্যার, আমারে কষ্ট দিয়েন না। আমারে স্যার ক্রসফায়ার দেন। আমারে শুধু শুধুই রাখছেন।’ তো পরে বলে, না, বাইচে থাকতে হলে তারা সবচেয়ে বেশি ফোকাস করতেছিল, তুমি কয়টা নাম বলে চলে যাও। নাম বলো। আমি বলছিলাম, নাম জানি না।

জঙ্গি সংশ্লিষ্ট, আমি নাম জানবো কেমনে? বড় স্যারে আমারে বললেন, ঠিক আছে, যাও, এক সপ্তাহের মধ্যে একটা ব্যবস্থা হবে। এই ব্যবস্থা করছিল ঠিকই, কিন্তু মাগার আমারে ইন্ডিয়া চালান করে দিলো। সবচেয়ে বেশি আমার কষ্ট হইছে এইটা যে আমারে ইন্ডিয়া চালান করল।

ওই ভুক্তভোগী বলেন, গাড়িতে উঠাইয়া আমাকে জম টুপি পরিয়ে ফেলে, যেটাতে আপনি স্বাভাবিকভাবে বাতাস নিতে পারবেন। অনেক ঘুরিয়ে পরে দু’জন লোকের কাছে হস্তান্তর করলো। এরপর তারা আরেকটি গাড়ি তোলে। পরে আমাকে কারাগারে দিলো। বিভিন্ন মাধ্যমে আমি জানার চেষ্টা করলাম, কারা আমাকে দিয়া গেছে এখানে বলতেছে, তোরে দিয়া গেছে এসটিএফ-এর লোকেরা। স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা সংস্থা। এসটি কী, এটা আমি আগে জানতাম না। ২৯ দিন পর নানা তালবাহানার পর আমাকে ফেরত পাঠানো হলো।

ওই ভুক্তভোগী বলেন, ছয় মাস পর আমাকে ফের ডিবিতে নিয়ে আনা হলো। এবার আমেরিকা থেকে দু’জন লোক এসেছিল। তারা শুধু আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যই আসেনি, তারা আরও অনেক লোককে এনেছিল। আমেরিকান দুই লোক একটা ফর্ম দিয়ে সেখানে ফিলাপ করতে বললো।

ডিবিতে থাকার পর ডিজিএফআইয়ের অফিসাররা বলেন, আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বিদেশীরা। এরপর নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছে।