বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে সম্প্রতি আরোপিত বর্ধিত শুল্কের কার্যকারিতা এক মাসের জন্য স্থগিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সরকারের এ সিদ্ধান্তে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। তবে তারা বলছেন, এটি সাময়িক সমাধান, স্থায়ীভাবে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত না এলে ভবিষ্যতে আবারও ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্যের উপর নতুন হারে শুল্ক আরোপ করা হয়। এর ফলে কাঁচামাল থেকে শুরু করে খাদ্যপণ্য, ভোগ্যপণ্য এবং শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় বেড়ে যায় কয়েক শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, হঠাৎ এই বৃদ্ধি তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ বলেন, ‘আমাদের আমদানি করা তুলা ও যন্ত্রাংশের ওপর হঠাৎ বাড়তি শুল্ক বসানো হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যেত। এতে রফতানিযোগ্য পোশাকের দাম প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ত।’ এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো যৌথভাবে সরকারের কাছে দাবি জানায়, যাতে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হয়।
শুল্ক বৃদ্ধির পেছনে সরকারের যুক্তি ছিল রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা কমানো। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ মোকাবেলা এবং স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন আনা হয়েছিল। একজন এনবিআর কর্মকর্তা জানান, ‘আমরা দীর্ঘমেয়াদে শিল্প ও অর্থনীতিকে টেকসই করার জন্য কিছু নীতিগত পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। তবে ব্যবসায়িক মহলের উদ্বেগ আমলে নিয়ে আপাতত এই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থগিতাদেশ কার্যকর হওয়ার পরপরই চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানিকারকদের মধ্যে স্বস্তি নেমে আসে। এর আগে নতুন করে শুল্ক আরোপের পর থেকে পণ্য ছাড় করার ব্যাপারে দোটানা তৈরি হয়। তবে স্থগিতাদেশ আসার পর আমদানিকারকরা এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কাস্টমস কার্যক্রম সম্পন্ন করছেন।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘আমরা সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। এক মাসের জন্য স্থগিতাদেশ ব্যবসায়ীদের শ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তবে আমাদের অনুরোধ থাকবে, ব্যবসা-বান্ধব ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান তৈরি করতে হবে।’ শুল্ক বৃদ্ধি স্থগিত হওয়ায় আপাতত পণ্যের দাম বাড়ার যে শঙ্কা ছিল, তা কিছুটা লাঘব হয়েছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য, ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে স্বস্তি এসেছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একজন প্রতিনিধি বলেন, ‘যদি শুল্ক বাড়ানো হতো, তবে সরাসরি ভোক্তার ওপর চাপ পড়ত। স্থগিতাদেশের কারণে অন্তত উৎসব মৌসুমে বাজারে অস্থিরতা বাড়বে না।’ তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, যদি সরকার আবারও হঠাৎ শুল্ক বাড়ায়, তা হলে তা কেবল ব্যবসায়ী নয়, সার্বিক বাজার ও মুদ্রাস্ফীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, শুল্ক নীতিতে ঘনঘন পরিবর্তন আনা হলে বিনিয়োগ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তারা দাবি করেছেন, সরকার যেন দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী শুল্ক নীতি প্রণয়ন করে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘আমরা চাই, নীতিনির্ধারকরা বাণিজ্যিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিক। হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে আমরা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে দায়বদ্ধতা রক্ষা করতে পারি না।’
বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ কার্যক্রম চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এই বন্দরকে কেন্দ্র করে পুরো দেশের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ঘুরে দাঁড়ায়। ফলে এখানে যে কোনো নীতি পরিবর্তনের প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে সরাসরি পড়ে। একজন শিপিং এজেন্ট বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের কাস্টমস কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে হাজারো ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত। তাই এখানে নেয়া প্রতিটি নীতিই সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ যদিও ব্যবসায়ীরা আপাতত স্বস্তি পেয়েছেন, তবে তাদের মনে উদ্বেগ থেকেই গেছে। এক মাস পর স্থগিতাদেশ উঠে গেলে কী হবে, সেটি নিয়েই তাদের দুশ্চিন্তা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বন্দরটি নকশা অনুযায়ী ধারণক্ষমতার বাইরে পরিচালিত হচ্ছে। এটি এখনও জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল এবং সীমিত গভীরতার কারণে এখনও বৈশ্বিক মানের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।’ তিনি দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা কনটেইনার দ্রুত খালাস, কাস্টমস স্বয়ংক্রিয়করণ এবং আগামী পাঁচ বছরের সম্ভাব্য বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি সামলাতে আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আমরা জানি না এক মাস পর সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে। তাই আমরা অর্ডার দেয়ার ক্ষেত্রেও দ্বিধায় আছি। স্থায়ী সমাধান ছাড়া ব্যবসায়িক পরিবেশ অনিশ্চিতই থেকে যাবে।’ চট্টগ্রাম বন্দরে বর্ধিত শুল্ক এক মাসের জন্য স্থগিত হওয়ায় ব্যবসায়ী সমাজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল ও ব্যবসা-বান্ধব শুল্কনীতি প্রণয়ন করে, তবে কেবল ব্যবসায়ীরা নয়, ভোক্তারাও উপকৃত হবেন। অন্যথায়, এক মাস পর আবারও বাজারে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা ফিরে আসবে বলে তারা মনে করেন।