হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পথে বড় বাধা ভারত

সিএনএনের প্রতিবেদন

যে দিন শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়, ওই দিনই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘বিলম্ব না করে’ তাকে হস্তান্তর করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানায়। মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী এটি ভারতের দায়িত্ব।’

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition

শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক উত্তেজনাপূর্ণ অচলাবস্থার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন। ঢাকা তার অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানাচ্ছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘তাকে পালাতে হয়েছিল। এটা নিজেই অপরাধের একটি স্বীকারোক্তি। জনগণ, বিভিন্ন বাহিনী সবাই তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। কারণ তিনি সীমা অতিক্রম করেছিলেন। তিনি হত্যা করেছেন, তার নির্দেশে এত এত মানুষ হত্যার শিকার হয়েছিল।

এক সহিংস অতীত

রাজনীতিতে শেখ হাসিনার যাত্রাপথ শেকসপিয়রীয় আদলের এক গল্পের মতো মর্মান্তিক ঘটনা, নির্বাসন ও ক্ষমতার আখ্যান, যা তার নিজ দেশের ইতিহাসের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে তিনি পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধিকারের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করার মধ্য দিয়ে জীবনের শুরুতেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের রক্তক্ষয়ী একটি রাতই সত্যিকার অর্থে তাকে এ পথে নিয়ে আসে।

ক্ষমতার ওপর শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণ আপাতদৃষ্টে অটুট মনে হয়েছিল। জনসমর্থন রয়েছে, এমন বিক্ষোভ মোকাবেলা, গ্রেফতার ও হত্যাচেষ্টার মতো ঝড় সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি পারদর্শী প্রমাণিত হয়েছিলেন; কিন্তু গত বছর তরুণদের নেতৃত্বাধীন যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, তা ছিল ভিন্ন।

অবশেষে ১৯৮১ সালে যখন তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন, তখন দেশটি তার প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সোচ্চার ছিল। তবে তিনিও এমন এক রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন, যা নির্ধারিত হতে যাচ্ছিল বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্যে নিপতিত হওয়া আরেক নারী খালেদা জিয়া, যার স্বামীও পরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন।

বাধ্যতামূলক নির্বাসন থেকে ফিরে আসার দিনটির কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘যখন আমি বিমানবন্দরে নেমেছিলাম, তখন আমার কোনো আত্মীয়কে দেখিনি; কিন্তু লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলাম। সেটিই ছিল আমার একমাত্র শক্তি।’

এভাবেই শুরু হয়েছিল ‘বেগমদের লড়াইয়ের’ যুগ দুই নারীর মধ্যে এক গভীর ব্যক্তিগত অথচ ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব, যার প্রভাব পরবর্তী ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশকে গ্রাস করেছিল।

‘তাকে পালাতে হলো’ : বাবার দল আওয়ামী লীগের হাল ধরে হাসিনা প্রতিকূল রাজনৈতিক পথে এক দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেন। খালেদা জিয়ার সাথে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের মধ্যে তাকে গৃহবন্দিত্ব ও দমন-পীড়ন মোকাবেলা করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা তার দলকে নির্বাচনী বিজয় এনে দেন এবং প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনা এক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার পর পরবর্তী নির্বাচনে খালেদা জিয়ার কাছে হেরে যান। কিন্তু ২০০৮ সালে তিনি যখন আবার ক্ষমতায় ফেরেন, তখন তাকে এক বদলে যাওয়া নেত্রী হিসেবে দেখা যায়, যিনি ছিলেন আরো দৃঢ়, কম আস্থাশীল এবং নিজের অবস্থান চিরস্থায়ীভাবে সুরক্ষিত করতে বদ্ধপরিকর।

পরবর্তী ১৫ বছর তিনি ক্রমেই কঠোরতার সাথে বাংলাদেশ শাসন করেন এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যুগের সূচনা করেন। একই সময়ে তিনি ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন দেন, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাচুক্তির মাধ্যমে নয়াদিল্লির হাতকে শক্তিশালী করেন, যা পাকিস্তান ও চীনের সাথে বৈরিতা সৃষ্টি করে।

তবে তাকে বাংলাদেশের উন্নয়নের সাফল্যের জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করেছিল যে, তিনি ও তার সরকার একদলীয় ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সমালোচকরা রাজনৈতিক সহিংসতার বাড়বাড়ন্ত, ভোটারদের ভয় দেখানো এবং গণমাধ্যম ও বিরোধী মতের ব্যক্তিত্বদের হয়রানির ক্রমবর্ধমান ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।

ভারতীয় সংবাদপত্র ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ সম্প্রতি এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছে, চাপ বাড়ার সাথে সাথে শেখ হাসিনা ‘ভারতের ওপর কোনো প্রশ্ন ছাড়াই পূর্ণ সমর্থনের জন্য নির্ভর করতে পারতেন।’

তবে দেশের অভ্যন্তরে তার ভাবমূর্তিতে এক আগ্রাসী দমন-পীড়নের কালিমা লেগে যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়েছেন।’

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে শুরু হওয়া ছাত্রবিক্ষোভ দ্রুতই তার পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী এক গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার দফতরের তথ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার এক নৃশংস দমন-পীড়ন চালায়, যাতে এক হাজার ৪০০ জনের মতো মানুষ নিহত হন।

তবে এই রক্তপাত আন্দোলনকে দমন করতে পারেনি; বরং তা আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তোলে, জনগণের ক্ষোভকে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করে, যা শেষ পর্যন্ত তার সরকারকে উৎখাত করে।

মৃত্যুদণ্ডের রায় : নয়াদিল্লিতে রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে শেখ হাসিনার জীবন তার গল্পকে পূর্ণ চক্রে ফিরিয়ে এনেছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে তিনি যে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছিলেন, সেই একই অবস্থায় তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে এই শরণার্থী জীবন।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধাপরাধ আদালত-আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনে একসময় হাসিনা নিজেই সহযোগিতা করেছিলেন। এ আদালতে হাসিনার বিরুদ্ধে মূলত বিক্ষোভ দমনে বিক্ষোভকারীদের হত্যায় উসকানি, বিক্ষোভকারীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ এবং বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র, ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, তিনি ছাত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা ‘একেবারে সুস্পষ্ট’।

ভুক্তভোগী একজনের বাবা আবদুর রব রয়টার্সকে বলেন, ‘এই রায় আমাদের মনে কিছুটা হলেও শান্তি এনেছে। কিন্তু তার গলায় জল্লাদের দড়ি দেখলেই আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হব।’

ভারতেও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান রয়েছে। দেশটি একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে রায়ের বিষয়টি পর্যবেক্ষণের কথা জানায় এবং বাংলাদেশের ‘সব পক্ষের সাথে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকার’ অঙ্গীকার করেছে।

কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভারত : এক দশকের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা ছিলেন ভারতের সবচেয়ে অটল আঞ্চলিক মিত্রদের একজন। তার সরকার ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমনে সহায়ক ছিল, যারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর আগে দুই দেশের বিস্তৃত সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার জন্য শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছিলেন। এখন তার সরকারের পতন হওয়ায় নয়াদিল্লিতে বড় ধরনের নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে কর্মরত সাবেক এক ভারতীয় কূটনীতিক অনিল ত্রিগুণায়েত বলেন, ‘ভারতকে এটি রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে দেখতে হবে, মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে নয়; যে অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অনিল ত্রিগুণায়েত বলেন, ‘শেখ হাসিনা এখনো সব আইনি প্রতিকার শেষ করেননি। তিনি রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারেন। এরপর হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ভারত তাকে পাঠানোর জন্য তাড়াহুড়ো করবে না।’

যে দিন শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়, ওই দিনই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘বিলম্ব না করে’ তাকে হস্তান্তর করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানায়। মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী এটি ভারতের দায়িত্ব।’

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বিভেদ ভুলে মিলেমিশে থাকার মতো অবস্থা থেকে অনেক দূরে। আওয়ামী লীগ হয়তো আবার রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে, যদিও তা হাসিনার নেতৃত্বে হওয়ার মতো নয়। এখন প্রশ্ন হলো হাসিনার বিদায় কি একটি বিষাক্ত যুগের অবসান ঘটাবে নাকি কেবলই অনিশ্চয়তার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। (সংক্ষেপিত)