ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের প্রকৃষ্টরূপ এবং বিপ্লবের প্রপঞ্চ

Printed Edition

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পটভূমিতে আরো বহুবিধ কারণ নিহিত ছিল যা উপযুক্ত সময়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা শেখ হাসিনা বা তার সহযোগীদের আয়ত্তের বাইরে ছিল। ফ্যাসিবাদী, স্বৈরশাসক, মাফিয়া ও অলিগার্ক শাসকদের পতনঘণ্টা বাজিয়ে বিপ্লবীরা রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এখন রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের কোনো কোনো বক্তব্য থেকে মনে হয় ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টের পরিবর্তনকে তারা এখনো বিপ্লব মনে করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। রাজনীতির শিক্ষার্থী হিসেবে বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।

ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। মতবাদটি বেশ জটিল ও বিতর্কিত একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ। ইতালির স্বৈরশাসক বেনিটো মুসোলিনি ও জার্মানির এডলফ হিটলার ফাসিবাদের মূর্তপ্রতীক ছিলেন। চ্যাট জিপিটি ফ্যাসিবাদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেছে তা হলো : ফ্যাসিবাদ কর্তৃত্বপরায়ণ, উগ্র জাতীয়তাবাদী, সামরিক শক্তি প্রয়োগে বিশ^াসী, সর্বাত্মকবাদী, কমিউনিজম বিরোধী, ব্যক্তিপূজায় বিশ^াসী, বিরোধী মতকে দমনকারী, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে বিশ^াসী, সামাজিক ডারউইনবাদে বিশ^াসে, নেতৃত্ব প্রদর্শনকারী এবং যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাবিরোধী। এসব সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রয়োগ ও প্রকাশ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নানারূপে প্রতিভাত হতে পারে।

অন্যদিকে, মাফিয়া বলতে বুঝায় একটি সংগঠিত শক্তি যারা নানাবিধ বেআইনি অপরাধের সাথে জড়িত থাকে। তবে এর প্রয়োগ ও প্রকাশও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন হতে পারে। চ্যাট জিপিটি মাফিয়ার যে বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেছে তা হলো : মাফিয়া চক্রের একটি নিজস্ব সাংগঠনিক ও নেতৃত্ব কাঠামো থাকে; তাদের বহু কাজ থাকে গুপ্ত ও অপ্রকাশ্য; তারা চাঁদাবাজি, চোরাচালান, অর্থপাচার, জুয়া, মানবপাচার, ঋণের ব্যবসা ইত্যাদি সামাজিক ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সম্পৃক্ত থাকে; তারা স্বার্থ-উদ্ধার ও বিরোধী পক্ষকে হিংসাত্মক পন্থায় দমন; ঘুস-দুর্নীতিতে লিপ্ত; তারা নিজেদের অন্যদের থেকে আলাদা মনে করে এবং একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের লালন করে; তারা বিভিন্নভাবে দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে; তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থাকে; মুদ্রা পাচার তাদের একটি প্রধান কাজ; তারা নিজস্ব সাঙ্কেতিক চিহ্ন বা স্লোগান ব্যবহার করে এবং তারা বেশ কৌশলী হয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়।

অলিগার্কি হচ্ছে এমন একটা শাসনব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকে একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণীর হাতে। শ্রেণীটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের ওপর ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। চ্যাট জিপিটি অলিগার্কের যে বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেছে তাহলো- এতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে একটি বিশেষ শ্রেণী বা পরিবারের হাতে; তারা রাজনীতিতে সাধারণ নাগরিকদের সীমিত অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়; তারা সিদ্ধান্ত-গ্রহণে সাধারণ জনগণের চেয়ে বিশেষ এলিট শ্রেণীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়; তারা দেশের অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়; তারা সমাজে বিভেদ ও শ্রেণী বিভাজন সৃষ্টি করে রাখে এবং অসমতার নীতি অনুসরণ করে; তারা সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব লোক নিয়োগ করে; তারা তাদের কর্মকাণ্ডে জবাবদিহির ধার ধারে না; তারা পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই পরিবার নেতৃত্বের পদগুলো দখল করে রাখে; তারা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে একদল চামচা বা অনুসারীদের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে লালন করে; তারা বিরোধী মত বা পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ সহ্য করতে পারে না এবং শক্তি প্রয়োগ করে তা দমন করতে সচেষ্ট হয়; তারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এমন বয়ান ও চেতনার অনুভূতি তৈরির চেষ্টা করে যার মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায় যে, দেশকে একমাত্র তারা উন্নয়নের শীর্ষে নিয়ে যেতে পারবে। মজার বিষয় হলো, অলিগার্কি একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক দলের মধ্যেও থাকতে পারে যেখানে কোনো একটি বিশেষ পরিবারকে সবার উপরে স্থান দেয়া এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা হয়।

এবারে দেখা যাক স্বৈরতন্ত্র কোনটি? স্বৈরশাসক হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্র বা সংস্থার ওপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী অথচ তিনি নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত নন। চ্যাট জিপিটি স্বৈরতন্ত্রের যে বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেছে তা হলো : যার হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে বিশেষ করে নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য থাকে না; গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি; বিরোধী মত ও শক্তির ওপর দমন-পীড়ন; প্রচার-প্রপাগান্ডায় সিদ্ধহস্ত; ব্যক্তিপূজার অনুশীলন; নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সীমিতকরণ; বিরোধী মত দমনে সামরিক শক্তির ব্যবহার; কোনো সময় ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব তার ইমেজ কাজে লাগিয়ে জনগণকে আবেগাপ্লুত করে রাখে; জাতীয় কোনো সঙ্কট দেখা দিলে তা উত্তরণে তার ক্ষমতায় থাকা যুক্তিসঙ্গত দেখাতে চায়; রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট থাকে; মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বিরোধীপক্ষকে দমাতে চেষ্টা করে এবং তার জবাবদিহি থাকে না।

উপরের অনুচ্ছেদসমূহে ফ্যাসিবাদ, মাফিয়া, স্বৈরাচার অলিগার্কের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হয়েছে তার প্রায় সব বিগত ২০০৮ থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল তাদের ক্ষেত্রে হুবহু মিলে যায়। তাদের অপরাধের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, স্বল্প কথায় তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন শুধু জুলাই-আগস্টের (২০২৪) বিপ্লব পূর্ববর্তী যেসব ঘটনা সঙ্ঘটিত হয়েছে; তার একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে- যাতে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের অপকর্মের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে। তবে ওই প্রতিবেদনে শুধু জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে; আওয়ামী শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরের পুরো চিত্র তুলে ধরা হয়নি। যাই হোক, তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

ফ্যাসিবাদ, মাফিয়া, অলিগার্ক বা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যখন বিপ্লব ঘটে যায়, তখন তার বৈশিষ্ট্যগুলোতে কী থাকে। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বিদ্যমান রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে শান্তিপূর্ণ বা হিংসাত্মক পন্থার মধ্য দিয়ে যখন ব্যাপকসংখ্যক জনগণ বা সামরিক শক্তি সফল হয় তাকে বিপ্লব বলা যায়। এক এক দেশে একেক রকমে বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। চ্যাট জিপিটি বিপ্লবের যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেছে তা হলো : বিপ্লবে ব্যাপকমাত্রায় জনসম্পৃক্ততা থাকে; বিপ্লবের পক্ষ শক্তির কতগুলো আদর্শ বা নীতি থাকে যার দ্বারা তারা উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ হয়-যেমন গণতন্ত্র, সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, বৈষম্য দূরীকরণ, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ইত্যাদি। এ ছাড়া বিপ্লব প্রধানত কায়েমি স্বার্থবাদী ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ঘটে; এক বা একাধিক সংগঠিত গোষ্ঠী বিপ্লবের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে; বিপ্লব সহিংসতা বা রক্তক্ষয় ছাড়া হয় না বললে চলে; বিপ্লব সাধারণত বিদ্যমান নিয়মকানুন, বিধি-বিধান ও প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করে থাকে; বিপ্লব বিদ্যমান নেতৃত্ব কাঠামো ভেঙেচুরে নতুন অবয়ব দান করে। ফলে নতুন নতুন নেতৃত্ব কাঠামো গড়ে ওঠে।

বিপ্লব-পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রকারের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে; কারণ নতুন নতুন শক্তি ক্ষমতার অংশীদার হতে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। বিপ্লবের স্বাভাবিক দাবি হচ্ছে, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার কাঠামো, সংবিধান, আইন-কানুন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক পরিবর্তন করা। সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য। বিপ্লবের একটি ঘোষণাপত্র থাকে যাতে বিপ্লবের উদ্দেশ্য ও জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে যে বিপ্লব ঘটে গেল তার পটভূমি নিয়ে একটু আলোকপাত করা দরকার। সমস্যাটি শুরু হয় মূলত ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে। তারা পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান যাতে তাদের পছন্দের লোক হতে পারেন সেজন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়স ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়। তারা ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। এরূপ সিদ্ধান্ত ছিল জোট সরকারের জন্য আত্মঘাতী। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা দলগুলো আন্দোলন গড়ে তুলতে একটি সুযোগ পেয়ে যায়। তারা আন্দোলনের নামে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড শুরু করে। এমনকি তারা ছয়জন জামায়াত কর্মীকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

দেশী-বিদেশী চক্রান্তে সেনাসমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। ওই সরকার প্রথমে চমক দেখানোর মতো কিছু কাজ করলেও ক্রমান্বয়ে আপসের পথে অগ্রসর হয়। তারা দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেত্রীকে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতায় পৌঁছে এবং তার দলকে ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী করার নীলনকশা প্রণয়ন করে। ওই নির্বাচন দৃশ্যত সুষ্ঠু হয়েছে বলে প্রতীয়মান ও প্রচারণা চালানো হলেও তা ছিল এক গভীর চক্রান্তের একটি নাটক। ভারতের পরলোকগত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির লিখিত বই থেকে তার প্রমাণ মেলে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের কিছু দিন পরে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। জনমনে এ ব্যাপারে শক্তিশালী ধারণা রয়েছে যে, ভারতের ইশারায় বা সম্পৃক্ততায় ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। বিদ্রোহীদের দমনে সরকারপ্রধানের নিস্পৃহতা এ ধারণা আরো জোরদার করে। এরপর ২০১০ সালে হাসিনা সরকার ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। ২০১২ সালে ঢাকার শাহবাগে মঞ্চস্থ হয় তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের নাটক। তারা সুপ্রিম কোর্টের উপর চাপ সৃষ্টি করে আদালতের রায় পাল্টাতে সক্ষম হয়। ওই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে দেশ-বিদেশে তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা করা হলেও হাসিনার সরকার একে একে বহু নেতাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে এবং জুডিশিয়াল কিলিংয়ের নিকৃষ্টতম ইতিহাস সৃষ্টি করে।

হাসিনার আজ্ঞাবহ সুপ্রিম কোর্ট ২০১১ সালে এক রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেন। এর ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়। ২০১৩ সালে ঘটে আরেকটি নির্মম ঘটনা। ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমবেত হওয়া লাখ লাখ আলেম ও মাদরাসা ছাত্রের ওপর চালানো হয় ধ্বংসযজ্ঞ। বিপুল রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সেদিন বিরোধী মত দমনের কালো ইতিহাস রচিত হয়। এরপর আসে ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরবর্তী দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের নির্দেশনা দেয়া হলেও হাসিনা সরকার তা পাত্তা না দিয়ে বিরোধী দলবিহীন এক তরফা নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ভোটারবিহীন ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৫৩ প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়। বিরোধী দল এতে অংশ নেয়নি, এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি বা তা বাতিল করা হয়। দেশ-বিদেশে ওই নির্বাচনকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে ঘোষণা করা হয়। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামী নেতৃবৃন্দের ফাঁসি ও গ্রেফতার-নির্যাতনে দলটি ছিল দিশেহারা। জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকলে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়।

এরপর আসে ২০১৮ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচনকে বলা হয় মধ্যরাতের নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সিভিল প্রশাসন সম্মিলিত নীলনকশার আওতায় ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নৌকা প্রতীকে সিল মেরে দেয়া হয় এবং তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ওই নির্বাচনে কোনো ভোটার ভোট দিতে পারেননি, কারণ তাদের ভোট রাতে চুরি হয়ে গিয়েছিল।

সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনকে বলা হয় ‘ডামি ইলেকশন’। কারণ সব বিরোধী দল তা বর্জন করেছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বহু নেতাকে তাদের দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলা হয়। এক প্রহসন ও তামাশার মধ্য দিয়ে সংসদ গঠিত হয়। নির্বাচন নিয়ে বারবার শেখ হাসিনা সরকারের প্রতারণায় নাগরিক সাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। একাধারে তারা তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। তরুণদের অনেকে ৩০-৩৫ বছরে পদার্পণ করলেও তারা জীবনে একবারও ভোট দিতে পারেননি। ফলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পটভূমিতে আরো বহুবিধ কারণ নিহিত ছিল যা উপযুক্ত সময়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা শেখ হাসিনা বা তার সহযোগীদের আয়ত্তের বাইরে ছিল। ফ্যাসিবাদী, স্বৈরশাসক, মাফিয়া ও অলিগার্ক শাসকদের পতনঘণ্টা বাজিয়ে বিপ্লবীরা রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এখন রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে। এ সময়ে পতিত ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার আর কোনো আশঙ্কা নেই।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব

[email protected]