দেশে পাখি বিলুপ্তির সাথে উদ্ভিদের বিস্তার কমছে। পরিসংখ্যান বলছে, দুই দশকে দেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে ছয় লাখ একর। আর নিরাপদ আবাসনের অভাব, বন উজাড়, বিষযুক্ত খাদ্য, বৃক্ষ কেটে স্থাপনা তৈরি এসব নানান কারণে পাখি কমছে। অন্য দিকে ৭১৫ প্রজাতির পাখির মধ্যে ঝুঁকিতে রয়েছে ৫০ প্রজাতি। এসব কারণে প্রাকৃতিকভাবে বিজের বিস্তার কমে যাওয়ায় নতুন গাছ বাড়ছে না। ফলে দিন দিন বৃক্ষহীন হয়ে পড়া পরিবেশ মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ভিদ মূলত দুইভাবে জন্মায়। প্রাকৃতিকভাবে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তার মধ্যে সবচাইতে বেশি জন্মে প্রকৃতিকভাবে। আর এ প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া বৃক্ষের পেছনে পাখির অবদান সবচাইতে বেশি। কারণ বনে জঙ্গলে নানান ধরনের গাছে ফল, ফুল হয়। সেগুলো পাখি খেতে গিয়ে বিজগুলো এদিকে ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে মানুষের স্পর্শ ছাড়াই বেশির ভাগ বৃক্ষ জন্ম নেয়, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ঢাল হিসেবে কাজ করে। কিন্তু পাখি কমে আসায় প্রাকৃতিগতভাবে বৃক্ষ জন্ম নেয়া কমছে। ফলে ধীরে ধীরে ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি।
পরিসংখ্যান বলছে, জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ছোট মাছ, পোকামাকড় মারা যায়। ফলে নিরাপদ খাদ্য সঙ্কটে পড়া পাখি বিষযুক্ত খাবার খেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। অন্য দিকে বন-জঙ্গল, ঝোপঝাড়, গাছগাছালি উজাড় ও বনে বসতি গড়ে ওঠায় পাখি বাসা বাধার নিরাপদ আশ্রয় না পেয়ে পাখি মুক্ত জীবন যাত্রায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে তার বেঁচে থাকার ঝুঁকি বাড়ছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন বলছে, বাংলাদেশে ৭১৫ প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে ৫০ প্রজাতির পাখি ঝুঁঁকির মধ্যে রয়েছে। আর বন কর্মকর্তা মো: আমীর হোসাইন চৌধুরীর ভাষ্য, দেশের মোট সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে ৩২০ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে এক শ পঞ্চাশটি ফসল প্রজাতিই মুখ্য, বাকিগুলোর বিপণন নির্দিষ্ট এলাকা বা স্থানীয় লোকদের মধ্যে সীমিত। তবে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ৯৫টি সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতি নানা পর্যায়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ লাখ সাড়ে ৯৬ হাজার একর (২০ লাখ ২২ হাজার হেক্টর) প্রাকৃতিক বনভূমি ছিল, যা মোট ভূমির ১৬ শতাংশ। প্রতিবছরই সেই বনভূমি কমছে। শুধু ২০২৩ সালেই বনভূমি কমেছে প্রায় ৪৪ হাজার একর।
অন্য দিকে বিগত সময়ে সরকার দেশের বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে দেশে প্রথম বারের মতো এক হাজার উদ্ভিদের তালিকা প্রস্তুত করে। যার মধ্যে ৩৯৪ প্রজাতি হলো সঙ্কটাপন্ন। যার মধ্যে আটটি প্রাথমিকভাবে বিলুপ্ত, পাঁচটি মহাবিপন্ন, ১২৭টি বিপদাপন্ন, ২৬২টি সঙ্কটাপন্ন, ৬৯টি প্রায় সঙ্কটাপন্ন, ২৭১টি ন্যূনতম উদ্বেগজনক এবং ২৫৮টি উদ্ভিদ প্রজাতিকে তথ্যের ঘাটতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে এমন অবস্থার জন্য মানুষের অসেচনতাকে দায়ী করা হয়। অন্য দিকে বন্যপ্রাণির ওপর এর বিরূপ প্রভাবও বৃদ্ধির জন্য পাখির খাবারের উৎস্য কমে যাওয়া, খামার তৈরি, জলবায়ুর পরিবর্তন, শহর-নগর আর রাস্তাঘাট নির্মাণ বন্যপ্রাণির আবাসস্থল ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ বলেও উল্লেখ করা হয়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, একটি দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি ঠিক রাখতে অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার হলেও বাংলাদেশে মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে।
তার ভাষ্য, বাসস্থান ও খাদ্য সঙ্কট, ফল-ফসলে কীটনাশক প্রয়োগ আর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বিলুপ্তির পথে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির নানা পাখি। পরিবেশ দূষণের ফলে আবহাওয়ার যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার ফলেও অনেক পাখি মারা যাচ্ছে। তা ছাড়া জলাশয়ের অভাবেও অনেক পাখি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি, পরিবেশ ও বন সৃষ্টিতে পাখির ভূমিকা অপরিসীম জানিয়ে তিনি বলেন, পাখি ও বৃক্ষহীন পরিবেশ এক সময় মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
দেশের পাখি গবেষক ইনাম আল হক জানান, ৩০ বছর আগে যেখানে একটি হাওর এলাকায় আমরা ছয় লাখ পাখি পেয়েছিলাম। এ বছর একই সময় সেখানে গুনে পেয়েছেন মাত্র এক লাখ পাখি। অনেক জলাশয়ে যেখানে এক সময় লক্ষাধিক পাখি দেখা যেত, এখন সেখানে মাত্র ৪০-৫০টি পাখি পাওয়া যাচ্ছে। তার মতে, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাখি কমছে এশিয়া মহাদেশে। এর মধ্যে বেশি কমছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আর এ কমার হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। তার ভাষ্য, জলজ পাখির পাশাপাশি কমছে শহর ও গ্রামের বনাঞ্চলের নানা জাতের পাখি। অব্যাহত উন্নয়নের ফলে পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ও কৃষিকাজে রাসায়নিক এবং বিষ ব্যবহারের ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে পাখি।