বিবিসি বিশ্লেষণ

‘ভঙ্গুর প্রতিশ্রুতি’ লাদাখকে মারাত্মক সহিংসতায় ঠেলে দিয়েছে

দীর্ঘদিন ধরে হিমালয়ের উঁচুতে লাদাখের অবস্থান পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় একটি অত্যাশ্চর্য অঞ্চল- ক্ষুদ্র লাদাখের ইতিহাস আধ্যাত্মিকতা, রহস্য ও অন্য জাগতিকতার অনুভূতির পরশ পেতে তারা সেখানে ছুটে যান। কিন্তু এখন, ভারত সফরে সেখানকার এই কল্পিত প্রশান্তি মারাত্মক সহিংসতায় ভেঙে পড়েছে।

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition

দীর্ঘদিন ধরে হিমালয়ের উঁচুতে লাদাখের অবস্থান পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় একটি অত্যাশ্চর্য অঞ্চল- ক্ষুদ্র লাদাখের ইতিহাস আধ্যাত্মিকতা, রহস্য ও অন্য জাগতিকতার অনুভূতির পরশ পেতে তারা সেখানে ছুটে যান। কিন্তু এখন, ভারত সফরে সেখানকার এই কল্পিত প্রশান্তি মারাত্মক সহিংসতায় ভেঙে পড়েছে।

ভারত থেকে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গত সপ্তাহে বিােভ শুরু হয় ও জনতা এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং কমপে ৮০ জন আহত হয়। পুলিশ বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং মানবাধিকারকর্মী সোনম ওয়াংচুককে গ্রেফতার করে, যিনি বিােভের অগ্রভাগে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে উসকে দেয়ার অভিযোগ দেয়া হয়েছে। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেন। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়ার পর, মনোরম রাজধানী লেহে কারফিউ জারি এবং আধাসামরিক বাহিনী পাঠানোর সময় আরো বিােভকারীদের আটক করা হয়। লাদাখে অসন্তোষ নতুন নয়, তবে সহিংসতা- কয়েক দশকের মধ্যে সেখানে সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছে।

দিল্লি ২০১৯ সালে এ অঞ্চলটি বিভক্ত করে সরাসরি শাসন শুরু করে। পূর্বে চীন ও পশ্চিমে পাকিস্তানের মধ্যে অবস্থিত, সমৃদ্ধ বৌদ্ধ অতীতের বিতর্কিত এই অঞ্চলটি ভারতশাসিত কাশ্মিরের অংশ। ২০২১ সাল থেকে বাসিন্দারা লাদাখের জন্য রাজ্যের মর্যাদা, চাকরির কোটা এবং বিশেষ মর্যাদার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছে, যা তাদের ভাষায় স্বতন্ত্র পরিচয় এবং সংস্কৃতি রার জন্য অপরিহার্য।

স্থানীয় একজন মহিলা জিগনা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমরা যা দেখেছি তা বছরের পর বছর ধরে তৈরি হওয়া ােভ এবং হতাশার ফলাফল। আমরা কী চাই তার প্রতি মানুষের মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে। লাদাখ সম্পর্কে মানুষের সব ধরনের রোমান্টিক ধারণা রয়েছে। কিন্তু সৌন্দর্যের বাইরে, এ অঞ্চলটি সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের একটি জটিল প্যাচওয়ার্ক, যার প্রতিটির নিজস্ব অনন্য ইতিহাস রয়েছে।’

গত সপ্তাহের ঘটনার সঠিক ক্রম এখনো স্পষ্ট নয় তবে বিােভকারীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, ২৪ সেপ্টেম্বর। ওয়াংচুক এবং দুই সপ্তাহ ধরে অনশনরত অন্যদের সমর্থনে হাজার হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে একটি পাবলিক পার্কে জড়ো হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ব্যবসায়ী গেলেক ফুঞ্চোক বলেন, ‘একপর্যায়ে, কিছু লোক, বিশেষ করে তরুণরা, অনুষ্ঠানস্থল থেকে সরে গিয়ে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু করে। এরপর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।’

অশান্তিতে কয়েক ডজন মানুষ আহত হন এবং ভারতের মতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একটি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পুলিশের দাবি, তারা গুলি চালিয়ে সহিংসতার জবাব দিয়েছে, কিন্তু বিােভকারীরা তা অস্বীকার করে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্ত চলছে। এর পর থেকে অনেক বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে- তবে ভয়, অবিশ্বাস ও গভীর আশঙ্কা এখনো লেহকে গ্রাস করে আছে। কর্তৃপ জনগণকে ‘সমাজবিরোধী এবং জাতীয়তাবিরোধী উপাদান যারা সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে’ তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে আরো তিক্ততা তৈরি করেছে।

রাজনৈতিক ও প্রতিরা বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা প্রকাশ করেছেন, বলেছেন যে, যেকোনো উত্তেজনা কেবল মানুষকে বিচ্ছিন্ন করবে, যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করবে। ২০১২-২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর উত্তর কমান্ডের প্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল দীপেন্দ্র সিং হুডা। তিনি বলেন, ‘লাদাখ একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চল, ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী- চীন ও পাকিস্তান- উভয়ের সাথেই সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে এই অঞ্চলটি স্থিতিশীল থাকবে। এই অঞ্চলটি ২০২০ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে মারাত্মক সীমান্ত সংঘর্ষের স্থান ছিল এবং এর মধ্যে কার্গিলও রয়েছে, যেখানে ১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তান একটি সংপ্তি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। লাদাখীরা ঐতিহ্যগতভাবে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেছে কিন্তু তাদের জাতীয়তাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার বর্ণনা পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু কারো কারো জন্য, পুনর্মিলন আর বিকল্প হতে পারে না।’

বিবিসির সাথে কথা বলা বেশ কয়েকজন বিােভকারী বলেছেন যে, তারা কোনো ধরনের সহিংসতাকে সমর্থন করেন না এবং এর বিরোধিতা চালিয়ে যাবেন। তবে যা ঘটেছে তাও উপো করা যায় না। লাদাখের তিন লাখ মানুষ প্রায় সমানভাবে মুসলিম এবং বৌদ্ধ। লেহ অঞ্চলে বৌদ্ধরা বেশি যারা মূলত উপজাতি- আর কার্গিলে মুসলিমরা বাস করে বেশি। ঐতিহাসিকভাবে, বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের জনগণের জন্য একটি পৃথক অঞ্চল দাবি করে আসছে এবং কার্গিলের লোকেরা মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত-শাসিত কাশ্মিরের সাথে একীভূত হতে চেয়েছে।

২০১৯ সালে, যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে, যা প্রাক্তন জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যকে জমি এবং চাকরির অধিকারসহ বিশেষ মর্যাদা দেয়, তখন লাদাখের বাসিন্দারা আশা করেছিল যে এই সিদ্ধান্ত তাদের সংস্কৃতিতে আরো স্বায়ত্তশাসন দেবে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করবে। কিন্তু সুবিধাগুলো তাদের কাছে পৌঁছায়নি।

১৯৯০-এর দশকে স্থানীয় রাজনীতিতে বাসিন্দাদের আরো বেশি কিছু বলার জন্য গঠিত পাহাড়ি পরিষদের স্বায়ত্তশাসন হ্রাস পেতে শুরু করে। পরিবর্তনগুলো অ-বাসিন্দাদের এই অঞ্চলে জমি এবং সম্পত্তি কিনতেও অনুমতি দেয়। যারা একসময় সরকারকে সমর্থন করতেন তারা এখন অভিযোগ করছেন যে তারা এই অঞ্চলটিকে ‘শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের’ জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছে এবং তাদেরকে জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ঝুঁকিতে ফেলছে।

বিােভকারীদের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন লাদাখ বৌদ্ধ সমিতির (এলবিএ) মহিলা শাখার সম্পাদক ডিস্কিত গাঙ্গজোর বলেন, ‘আমরা প্রতারিত বোধ করছি। আমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে আমাদের জমি, চাকরি এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় সুরতি করা হবে কিন্তু এটি ছিল মিথ্যা।’

ােভ বৃদ্ধির সাথে সাথে, কার্গিল এবং লেহের বাসিন্দারা হাত মিলিয়ে তাদের অঞ্চলের জন্য পূর্ণ রাজ্যের দাবি জানান। অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিল নামে পরিচিত একটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, যা সংবিধানের অধীনে ভূমির সুরা এবং উপজাতি অঞ্চলগুলোকে নামমাত্র স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দেয় এবং পাশাপাশি লেহ ও কার্গিল জেলার জন্য একটি সংসদীয় আসনও নিশ্চিত করে।

বছরের পর বছর, লাদাখের প্রধান অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো ফেডারেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে বেশ কয়েক দফা আলোচনা করেছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি। ইতোমধ্যে, এই অঞ্চলে বেকারত্ব বেড়েছে, যার ফলে এর তরুণরা ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছে। এই প্রোপটেই ওয়াংচুক এবং অন্যারা গত মাসে তাদের প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন।

নারী অধিকার কর্মী নারদন শুনু বলেন, ‘২৪শে সেপ্টেম্বর যা ঘটেছিল তা কেবল সেই একদিনের ঘটনা ছিল না। এটি বিচ্ছিন্নভাবে বোঝা যাবে না- এই হতাশা কোথা থেকে আসছে তা আপনাকে দেখতে হবে।”

ওয়াংচুকের গ্রেফতারের পর থেকে, অঞ্চলের প্রধান নাগরিক সমাজের গোষ্ঠীগুলো ফেডারেল সরকারের সাথে সংলাপ থেকে সরে এসেছে। বিােভকারীরা বলছেন যে, তাদের সবচেয়ে সোচ্চার নেতাকে আটক করা হলেও তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। ব্যবসায়ী ফুঞ্চোক বলেন, ‘আমরা যা করছি তা দেশবিরোধী নয়। এগুলো আমাদের আসল দাবি এবং আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ল্য অর্জন করব। [সংঘর্ষের দিন] সেদিন যা ঘটেছিল তা অন্য স্তরের বিশৃঙ্খলা বলে মনে হয়েছিল, এ থেকে সেরে উঠতে অনেক সময় লাগবে।’ আপাতত, শান্তির পথ অনিশ্চিত দেখাচ্ছে।

গত সপ্তাহ থেকে শত শত সৈন্য লেহের অন্যতম প্রধান পাবলিক পার্ক- বিােভস্থল পাহারা দিচ্ছে। বিােভকারীরা বলছেন যে, তারা তাদের আন্দোলন ফের শুরু করতে চান, কিন্তু কখন তা ঘটবে তা জানেন না। প্রতিশোধের ভয়ে তাদের অনেকেই অজ্ঞাত অবস্থায় চলে গেছেন।