রিজার্ভ থেকে ব্যবসায়ীদের ডলার প্রদানের তথ্য তলব

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছরে মাত্রা ছাড়ানো বৈদেশিক মুদ্রা পাচারে রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। প্রতি মাসেই রিজার্ভ থেকে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার ক্ষয় হতে থাকে। একপর্যায়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। আর এর অন্যতম কারণ ছিল রিজার্ভ থেকে এস আলম, বেক্সিমকোসহ কয়েকটি মাফিয়া ব্যবসায়ী গ্রুপকে ডলার সরবরাহ করা হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। বৈদেশিক দায় পরিশোধের নামে এ ডলার প্রদান করা হয়। অভিযোগ উঠেছে এর সরাসরি নির্দেশ দাতা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এমনি পরিস্থিতিতে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের কার্যকালে রিজার্ভ থেকে কী পরিমাণ ডলার প্রদান করা হয়েছে তার নোটশিটসহ নথি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ তথ্য চাওয়া হয়েছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, পতিত সরকারের শেষ সময়ে আমদানির নামে দেদার পাচার হয় বৈদেশিক মুদ্রা। দেখানো হয় আমদানি প্রবৃদ্ধি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ হচ্ছে। এর মধ্যে মুলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি দেখানো হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। যে পরিমাণ পণ্য আমদানি দেখানো হয় বাস্তবে সেই পরিমাণ পণ্য দেশে আসেনি। কিন্তু বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা ঠিকই পরিশোধ করা হয়। কখনো বেসরকারি পর্যায়ে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে, কখনো বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে, আবার কখনো সরাসরি এলসির মাধ্যমে পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করা হয়। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৪ সালে পতিত সরকারের বিদায়ের আগ পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। দৃশ্যমান তেমন কোনো বিনিয়োগ ছিল না তখন। এরপরেও বিনিয়োগের নামে কোটি কোটি টাকা পাচার করা হয়। একপর্যায়ে ব্যাংকগুলো রফতানি ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে তা দিয়েও কুলানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত মাফিয়াদের চোখ পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ব্যবসায়ীদের ডলার সহায়তা দেয়ার চাপ বাড়তে থাকে। অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির দায় পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা চাওয়া হয়। অনেকটা রাজনৈতিক চাপে অর্থাৎ সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যবসায়ীদের ডলার সরবরাহের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এর পর থেকে প্রতি কার্যদিবসেই নানা তদবির আসতে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাধ্য হয়ে অনেকটা চাপে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়ীদের ডলার সরবরাহ করতে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট (এফআরটিএমডি) ভিাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর ছিলেন কাজী ছাইদুর রহমান। কিন্তু হঠাৎ করে তাকে এ বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। নতুন করে দায়িত্ব দেয়া হয় ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো: নাছেরকে। মূলত ওই সময়ে রিজার্ভ থেকে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, ওই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার মানদণ্ড অনুযায়ী তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য নিট রিজার্ভ থাকার কথা, সেখানে এ সীমারও নিচে নেমে যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। জানা গেছে, ওই সময়ে প্রতি মাসেই গড়ে সাত থেকে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার করে আমদানি হচ্ছিল। এ হিসেব অনুযায়ী রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২২ থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু রিজার্ভ নেমে যায় ২০ বিলিয়নের নিচে। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে আর কোনো ডলার বিক্রি করতে নারাজ ছিলেন কাজী ছাইদুর রহমান। এ সংক্রান্ত গভর্নরের অনেক নির্দেশনা তিনি অমান্য করতে থাকেন। এরই এক পর্যায়ে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। নতুন দায়িত্ব দেয়া হয় আরেক ডেপুটি গভর্নরকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল আরেক সূত্র জানিয়েছে, এখানে গভর্নরেরও তেমন করার কিছু ছিল না। কারণ যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িয়ে পরেছিল অর্থ পাচারের সাথে, সেখানে গভর্নরের শক্ত অবস্থানে থাকার কোনো উপায় ছিল না। রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির নির্দেশনা অমান্য করলে গভর্নরকেও চাকরি খোয়াতে হতো। আর এ কারণেই কাজী ছাইদুর রহমানকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রিতে আর কোনো বাধা ছিল না। যদিও ওইসময় প্রতিদিন যে পরিমাণ চাহিদা ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরবরাহ করা হতো তার এক-দশমাংশ। তারপরেও প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার। এক পর্যায়ে নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়।

গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর তার সাথে মন্ত্রী, এমপি, উচ্চ পর্যায়ের আমলা সবাই গা ঢাকা দেন। এতে বাদ ছিলেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ৫ আগস্টের পর আর একদিনও বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেননি। কোথায় গিয়েছেন তাও কেউ জানেন না। ঠিকানাবিহীন হয়ে গেছেন। এরপর নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর।

সম্প্রতি দুদক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের কার্যকালে রিজার্ভ থেকে ব্যবসায়ীদের কী পরিমাণ ডলার সরবরাহ করা হয়েছে তার নোটশিটসহ যাবতীয় নথি দুদককে সরকার করতে অনুরোধ করা হয়েছে।