দেশজুড়ে আমন মৌসুমের ধান কাটা পুরোদমে চললেও কৃষকের মুখে স্বস্তির বদলে এবার দুশ্চিন্তাই বেশি। মাঠে ফলন ভালো হলেও বাজারে ধানের দাম গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে অব্যাহত চাল আমদানি এবং বড় মিলার গোষ্ঠীর আগাম বাজার দখলের কৌশল স্থানীয় বাজারে দাম কমিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে কৃষকদের কিছুটা স্বস্তি দিতে সরকার ৭ লাখ টন ধান ও চাল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে, যা ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ ও রাজশাহীর বিভিন্ন হাটে শুকনো গুটি স্বর্ণা ধান বর্তমানে প্রতি মণ ১,২০০ থেকে ১,২৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর একই সময়ে দাম ছিল ১,৩০০ থেকে ১,৩২০ টাকা। এ ছাড়া শম্পা কাতারী জাতের ধানের দাম গত বছরের তুলনায় ৭ থেকে ৮ শতাংশ কমেছে। বর্তমানে প্রতি মণ ১,৫০০ থেকে ১,৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের এই সময় প্রতি মণের দাম ছিল ১,৬৩০ টাকা।
নীলফামারীর ডিমলার কৃষক ইমতিয়াজ কবীর বলেন, এখন গুটি স্বর্ণা ধান বিক্রি করে লাভের হার অনেক কম। অনেকেই লোকসান করছে। দুই মাস মজুদ রাখতে পারলে দাম বাড়তে পারে, কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষকের সেই সামর্থ্য নেই। তিনি বলেন, ভারতীয় চালের অব্যাহত প্রবেশ স্থানীয় বাজারে ধানের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে।
দিনাজপুরের খানসামার কৃষক সুজা রহমান বলেন, সরকারি ক্রয়মূল্য কাগজে-কলমে আকর্ষণীয় হলেও ‘পুরোপুরি শুকনো ধান’ দেয়ার শর্তের কারণে কৃষকদের বড় অংশই সরকারি সংগ্রহ কেন্দ্রে ধান দিতে পারেন না। তিনি বলেন, ধান কাটার পর পুরোপুরি শুকানো খুব কঠিন, তাই দেয়ার চেষ্টা করলেও বাধা আসে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ব্যাপক হারে ভারতীয় চাল ঢুকছে। ভারত থেকে আমদানিকৃত চালের দাম ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। আমদানিকৃত কমদামের চাল বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ওলিমা ট্রেডার্সের মালিক হাজরাত আলী সাহজিব নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণে চাল ঢুকছে। এতে স্থানীয় ধানের দাম নিম্নমুখী। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে অক্টোবর সময়কালে বেসরকারি খাতে ৪ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২,৬৩০ টন চাল দেশে প্রবেশ করছে বলে তথ্যে দেখা গেছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডি নয়া দিগন্তকে বলেন, বড় মিলারগোষ্ঠী এবং তাদের মোড়লরা মাঠপর্যায়ে আগেভাগেই ধান সংগ্রহে নেমেছে। তাদের এজেন্টরা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কেনার কৌশল নিয়ে কাজ করছে। তারা এখনই বেশি পরিমাণ ধান সংগ্রহে ব্যস্ত।
তিনি বলেন, কৃষককে স্বস্তি দিতে আগামী দুই মাস আমদানি স্থগিত করা জরুরি। বাজারে আমদানির চাপ কমানো ছাড়া কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, পাহাড়ি ও হাওর এলাকায় ধানের দাম আরো কম। সেখানে খাদ্য অধিদফতরকে সংগ্রহ কার্যক্রম আরো বাড়াতে হবে।
এ দিকে সরকার আমন মৌসুমে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৭ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য চলতি বছর ধান, চাল সংগ্রহের মূল্যও নির্ধারণ করা হয়েছে। সিদ্ধ চালের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ৫০ টাকা। আতপ চাল প্রতি কেজি ৪৯ টাকা এবং ধান প্রতি কেজি ৩৪ টাকা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, গ্রামে ধানের দাম কমলেও খুচরা বাজারে তার প্রভাব নেই। ঢাকার বাজারে ৫৫ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। মাঝারি মানের চাল ৬৫ থেকে ৬৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক মাসে দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। তার মতে, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের অস্বচ্ছতা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণেই বাজারে ধান-চালের প্রকৃত পরিস্থিতি প্রতিফলিত হয় না বলে তিনি মনে করেন।
তথ্যে দেখা যায়, চলতি মৌসুমে বাংলাদেশ প্রায় এক কোটি ৭৮ লাখ টন আমন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ হতে পারে। কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও যদি কৃষকপর্যায়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হয়, তাহলে আগাম মৌসুমে উৎপাদনে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।



