সংস্কার মাঝপথে রেখেই নির্বাচনী ট্রেনযাত্রা

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ সম্মেলন আজ

দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকে মোট ১৯টি বিষয়ে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে কতিপয় দলের নোট অব ডিসেন্টসহ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এর বাইরে আরো কিছু বিষয় এখনো অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক |ফাইল ফটো

সংস্কার কার্যক্রম মাঝপথে রেখেই ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের ট্রেনযাত্রা শুরু করেছে সরকার। এ নিয়ে বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল সন্তুষ্ট হলেও স্বৈরাচারবিরোধী পক্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। একই প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার পতনে নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়।

জুলাই সনদ প্রণয়ণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই দফা সংলাপ করেছে। দ্বিতীয় দফায় ২৩ দিনের মতো আলেচনা শেষ হয় গত ৩১ জুলাই। দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকে মোট ১৯টি বিষয়ে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে কতিপয় দলের নোট অব ডিসেন্টসহ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এর বাইরে আরো কিছু বিষয় এখনো অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো নিষ্পন্ন করা এবং নোট অব ডিসেন্টসহ যেসব বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে তৃতীয় দফা আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে কমিশন। কিন্তু এরই মধ্যে গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রমজান শুরুর আগে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্তি আজ। গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন হয় দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের। ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। প্রায় দুই হাজার মানুষের জীবন এবং ৪০ হাজার মানুষ এ আন্দোলনে আহত হয়। শত শত ছাত্র-জনতার জীবন ও হাজার হাজার মানুষের রক্তের উপর দায়িত্ব নেয় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শুরু থেকেই দাবি ওঠে রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ সবক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন আনা। যাতে করে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মতো আর স্বৈরাচারের জন্ম না হয়। আওয়ামী লীগের মতো আর দানবীয় শাসন না আসে। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করে। এসব কমিটি বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনয়নের সুপারিশ জমা দেয় সরকারের কাছে। সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টের সুপারিশগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, এ বিষয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সভাপতি ড. ইউনূস হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত সংলাপে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো: এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো: আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার এসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক শেষ হয়। এদিন অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকে মোট ১৯টি বিষয়ে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিষয় গৃহীত হয় কতিপয় দলের নোট অব ডিসেন্টসহ। তিনি বলেন, যে সকল বিষয়ে ঐকমত্য বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে।

তিনি জানান, নোট অব ডিসেন্টসহ যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা হলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, নারী প্রতিনিধিত্ব, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ও সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা, সরকারি কর্মকমিশন, দুদক, সি এন্ড এজি এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে সংযোজন করা, উচ্চকক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮, ৯, ১১ এবং ১২ ক্রমিক নম্বরের প্রস্তাবসমূহ, এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, নারীদের আসন বৃদ্ধির প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট এসেছে। তিনি আরো জানান, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ-মার্কসবাদী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি নোট অব ডিসেন্ট প্রদানসহ সভা বর্জন করে। এ ছাড়া গণফোরামের প্রতিনিধি এ ইস্যুতে ভিন্নমত প্রদান করলেও সভা বর্জন করেননি। আলী রীয়াজ জানান, দীর্ঘ ২৩ দিনের আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেসব বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রথমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশন অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে এবং এরপর যথাসময়ে কমিশন দলগুলোর সাথে আবারো আলোচনায় বসবে।

গত ৩ আগস্ট কমিশনের বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা পর্যালোচনা করা হয়। সভায় আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ঐকমত্য হওয়া প্রস্তাব বা সুপারিশসমূহের বিষয়ে কমিশন পর্যায়ক্রমে বিশেষজ্ঞগণের সাথে এবং সেই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সাথে কথা বলবে। এসব প্রস্তাব বা সুপারিশ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশন, রাজনৈতিক দল ও জোট এবং সরকারের করণীয় বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা হবে।

ইতোমধ্যে কমিশন হতে প্রেরিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর প্রাথমিক খসড়ার ওপর অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ মতামত দিয়েছে এবং যেসব দল এখনো সাড়া দেয়নি তাদেরকে দ্রুত মতামত জানাতে তাগিদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এ অবস্থায় চলতি সপ্তাহ থেকেই ফের সংলাপ শুরু করতে চায় কমিশন। জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের অগ্রগতি সম্পর্কে আজ বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।