বৃষ্টিপ্রবণ বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনা করার আগে বঙ্গোপসাগর বা মহাসাগরীয় জলবায়ুর অবস্থা বিশ্লেষণ করে নেয়া উচিত। এ ব্যাপারে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাগর বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের জলবায়ু নিয়ে যারা বা যে সংস্থাগুলো গবেষণা করে তাদের পূর্বাভাস নিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনায় হাত দিলে শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। কারণ জলবায়ুর অবস্থা বিশ্লেষণ না করে অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দিলে তা পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
এ ব্যাপারে নয়া দিগন্তের সাথে সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের জুলি অ্যান রিগলি গ্লোবাল ফিউচারস ল্যাবরেটরির সিনিয়র গ্লোবাল সায়েন্টিস্ট ড. মো: রাশেদ চৌধুরী বলেন, বড় কোনো বন্যা হয়ে গেলে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা অপরিকল্পিত নগরায়ন, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং রক্ষণাবেক্ষণকে দায়ী করে থাকেন। এই মূল্যায়ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের একটি বড় দৃষ্টিকোণ থেকেও ভাবা জরুরি, তা হলো- জলবায়ুগত ও মহাসাগরীয় চালিকাশক্তি।
ড. রাশেদ চৌধুরী বলেন, বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের মাত্রা এবং প্রকৃতি অনেকাংশেই মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডলের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নয়া দিগন্তের বিশেষ সংবাদদাতা হামিম উল কবির।
নয়া দিগন্ত : আপনার বিভিন্ন লেখায় আপনি বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক জলবায়ুর অবস্থা বিশ্লেষণ করতে বলে থাকেন, এটা কি খুব জরুরি ?
ড. মো: রাশেদ চৌধুরী : হ্যাঁ, এটা খুবই প্রয়োজনীয়, খুবই জরুরি। এটা আগে করে নিলে বাংলাদেশের অনেক অর্থের অপচয় হবে না। বরাবরের মতো চলতি বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ আবারো এক ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। ফেনী ও চট্টগ্রামসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে টানা ভারী বৃষ্টিপাত শহরাঞ্চলে ব্যাপক জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। ফেনী শহরে রাতভর বৃষ্টির ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বাজার, আবাসিক এলাকা ও প্রধান সড়কগুলোতে জমে থাকা পানি জনজীবন কার্যত স্তব্ধ করে দেয়। বৃহৎ-পরিসরে এই জলবায়ু প্রক্রিয়াগুলো বিশ্লেষণ করে উপসংহারে পৌঁছতে পারলে বন্যা ও অতিবৃষ্টির ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব হতো।
নয়া দিগন্ত : সাগর ও মহাসাগরীয় জলবায়ুর ব্যাপারটি একটু স্পষ্ট করে বলুন।
ড. রাশেদ চৌধুরী : ২০২৫ সালের জুন-আগস্ট সময়কালে বৈশ্বিক জলবায়ু পূর্বাভাস কেন্দ্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এল নিনো-সাউদার্ন অসসিলেশন (ইএনএসও) ছিল নিরপেক্ষ অবস্থায়। নভেম্বর ২০২৫ থেকে জানুয়ারি ২০২৬ সালের মধ্যে ইএনএসও নিরপেক্ষ অবস্থা বজায় রাখার সম্ভাবনা ছিল ৪৬ শতাংশ এবং লা নিনা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ৪১ শতাংশ। এ ছাড়া ভারত মহাসাগরীয় ডাইপোল (আইওডি) তখনও নিরপেক্ষ পর্যায়ে থাকলেও গ্রীষ্মের শেষ দিকে তা নেতিবাচক ধাপে প্রবেশ করে। ডাইপোল মোড ইনডেক্স (ডিএমআই) মে মাসে +০.২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও জুনে তা কমে -০.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। এটা নেতিবাচক আইওডির একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত। অন্য দিকে ম্যাডেন জুলিয়ান অসসিলেশন (এমজেও) মে মাসে দুর্বল অবস্থায় ছিল, কিন্তু জুনের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গোপসাগরে সেটা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে বঙ্গোপসাগরে মেঘমালার ঘনত্ব ও মৌসুমি বায়ুর গতি বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাব বাংলাদেশে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ও বন্যার রূপে দৃশ্যমান হয়। নেতিবাচক আইওডি ও সক্রিয় এমজেও বৃষ্টিপাতের জোড়া চালিকাশক্তি হয়ে
নয়া দিগন্ত : মৌসুমি বায়ু, মেঘমালার ঘনত্বের কারণে বলছেন বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এ বিষয়টি ব্যাখা করে বলুন।
ড. রাশেদ চৌধুরী : নেতিবাচক আইওডির সময় পূর্ব ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে বলে বঙ্গোপসাগরে বাষ্পীভবন বেড়ে যায়। এই বাষ্পীভবন বেড়ে যাওয়ায় বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত আর্দ্রতা যোগ করে দেশের আকশে নিয়ে আসে আরো বেশি উষ্ণ পানি ও আর্দ্র বাতাস। এসব কারণে মৌসুমি বায়ু আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে, ফলে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য দিকে সক্রিয় এমজেও বৃষ্টির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে। এটি বঙ্গোপসাগরের মেঘমালা (কনভেকশান) ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি করে মৌসুমি বায়ুর শক্তি বাড়ায় এবং বায়ুমণ্ডলকে আরো অস্থির করে তোলে। এভাবে ভারী বৃষ্টিপাতের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে এই দু’টি প্রক্রিয়া একসাথে ঘটলে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্যার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। চলতি বছরের জুনের বন্যা ঠিক এই রকম একটি পরিস্থিতির কারণে ঘটেছে।
নয়া দিগন্ত : জলবায়ু বিশ্লেষণে বাংলাদেশ কি করতে পারে?
ড. রাশেদ চৌধুরী : বৈশ্বিক জলবায়ুর চালিকাশক্তি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকভাবে এখন অনেক কিছু জানা যায়, বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণা এখনো সীমিত, খণ্ডিত এবং অর্থায়নের অভাবে পর্যাপ্তভাবে গড়ে ওঠেনি। এই ঘাটতি পূরণে দরকার : আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা ও সহযোগিতা; উন্নত জলবায়ু মডেলিং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ; স্থানীয় জ্ঞানকে বৈশ্বিক গবেষণার সাথে সংযুক্ত করা যেতে পারে। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিতে পারে। একটি তথ্যনির্ভর ও জলবায়ুর জ্ঞান বাংলাদেশের উন্নয়নে অনেক বেশি সুযোগ তৈরি করতে পারে বলে ড. রাশেদ চৌধুরী মনে করেন।