হাওরে আধুনিক ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রতি সেতুতে খরচ সোয়া ৩১ লাখ টাকা!

গোপাট নির্মাণে প্রতিটিতে খরচ ২ কোটি টাকা

সেচ উইং বলছে, প্রকল্পটি নিয়ে কয়েক দিন আগে পিইসি হয়েছে। বেশ কিছু নির্দেশনাসহ ডিপিপি সংশোধন করে আবার পাঠাতে বলা হয়েছে।

হামিদ সরকার
Printed Edition

খাদ্যঘাটতি মোকাবেলায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দেশের দুইটি হাওর এলাকার কৃষি জমিকে আধুনিক ক্ষুদ্রসেচের উন্নয়ন প্রকল্পে আনা হচ্ছে। অনাবাদি জমি সেচের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গৃহীত এ প্রকল্পের বিভিন্ন খাতের ব্যয় নিয়ে খোদ মূল্যায়ন কমিটির সভায় প্রশ্ন উঠেছে। খাল পারাপারে প্রতিটি সেতু তৈরিতে খরচ ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রকল্পে গোপাট নির্মাণে প্রতিটিতে দুই কোটি টাকা ধরা হয়েছে। আবার খাল পুনঃখননে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ২২ কোটি টাকা। যেখানে অন্য প্রকল্পে ১৬ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে এবং সেচনালা তৈরিতে ব্যয় হবে সাড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা, সেখানে এই প্রকল্পে ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। চলমান প্রকল্পের সাথে তুলনামূলক ব্যয় বিশ্লেষণে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রস্তাবিত কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার হাওর এলাকায় ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন প্রকল্পটির খরচগুলো যৌক্তিক করার জন্য বলা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা শস্য উৎপাদনের আধার বলে পরিচিত। এই দুই জেলায় ভূপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা প্রচুর। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, কালনী-কুশিয়ারা, ঘোরাউত্রা, ধনু, নরসুদ্ধা, কংশ, ধলাই, নিতাই, সোমেশ্বরী, মগরা, আড়িয়াল খাঁ, সিশুয়া ইত্যাদি নদী মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় টারশিয়ারী ও সেকেন্ডারি খালের মাধ্যমে ভূউপরিস্থ পানি প্রবাহিত হয়। প্রকল্প এলাকায় ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেচযন্ত্র স্থাপন করে সেচ ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন করা জরুরি। পাশাপাশি যথাযথ সেচ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণাগার তৈরি করে বন্যার পানি ও বৃষ্টির পানি ধরে রাখা দরকার। এ জন্য স্থানীয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্প এলাকায় খাল পুনঃখনন ও পুনঃসংস্কার করা জরুরি।

কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার হাওর এলাকায় ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। প্রকল্পের প্রাক্কলিত খরচ ধরা হয়েছে মোট ১৪৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, যার পুরোটাই বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন (জিওবি)। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাল জুলাই ২০২৫ হতে জুন ২০২৯ পর্যন্ত ধরা হয়েছে। প্রকল্প এলাকাগুলো হলো, কিশোরগঞ্জ জেলার, কিশোরগঞ্জ সদর, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, করিমগঞ্জ, তাড়াইল, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, কুলিয়ারচর, ভৈরব, নিকলী, কটিয়াদি এবং বাজিতপুর- উপজেলা। আর নেত্রকোনা জেলার নেত্রকোনা সদর, দুর্গাপুর, মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা, মদন, আটপাড়া, খালিয়াজুড়ি, কেন্দুয়া, বারহাট্টা এবং পূর্বধলাসহ ২৩টি উপজেলা।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো- খাল খনন, পুনঃখনন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ, গোপাট নির্মাণ এবং গ্রেসিং ও সানিং ফ্লোর নির্মাণ ইত্যাদির মাধ্যমে সুরক্ষা প্রদান। প্রকল্প এলাকায় ৯৩০ জন কৃষক-কৃষানীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন। যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদান করে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, ২০০ জন কৃষানী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ও বৈষম্য দূর করা এবং দারিদ্র্য বিমোচন করা। প্রয়োজনীয় সেচ অবকাঠামো নির্মাণ এবং সেচযন্ত্র ক্ষেত্রায়নের মাধ্যমে ভূউপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার করে ৫ হাজার ৫৬৮ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা। এতে ৩০ হাজার ৬২৪ মেট্রিক টন বাড়তি খাদ্যশস্য ও শাকসবজি উৎপাদন হবে।

খরচের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন আকারের খালের ওপর ৩০টি পায়ে চলাচলের সেতু নির্মাণে খরচ হবে ৯ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ফলে প্রতিটির ব্যয় ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। খাল পুনঃখননে প্রতি কিলোমিটার বা ১৫ হাজার ঘন মিটারে ধরা হয়েছে ২২ লাখ টাকা, যেখানে চট্টগ্রামে একই কাজে ১৬ লাখ টাকা এবং সিলেটের প্রকল্পে ছিল সাড়ে ১৩ লাখ টাকা। গোপাট নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ধরা হয়েছে ২ কোটি টাকা। যেখানে পাবনা-নাটোর- সিরাজগঞ্জ সেচ প্রকল্পে ৯০ লাখ টাকা এবং নেত্রকোনার কমলাকান্দা উপজেলার সেচ কর্মসূচিতে ছিল এক কোটি টাকা।

প্রকল্পে ৫ কিউসেক এলএলপি স্কিমে ভূগর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণে (২২০০ মিটার) একক দর ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। যেখানে প্রতিটি এক হাজার মিটার পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলায় ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ কর্মসূচিতে খরচ সাড়ে ৭ কোটি টাকা ছিল। আর প্রতিটি এক হাজার মিটার ময়মনসিংহ বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইলে ছিল ৮ লাখ টাকা। খালের পাড়ের পানি বেরুতে পথ নির্মাণে ১০০টির জন্য ব্যয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটি পথের পেছনে খরচ এক লাখ ২০ হাজার টাকা। মালামালসহ গভীর নলকূপ স্থাপনে ৩০টিতে ব্যয় হবে ৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। প্রতিটির ব্যয় হবে সাড়ে ২০ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় খাল হতে নদী পর্যন্ত সংযোগ খাল ড্রেজিং প্রি ও পোস্ট ওয়ার্ক সার্ভে খাতে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) দাফতরিক কাজের মধ্যে পড়ে বলে মন্তব্য করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সেচ উইং।

প্রকল্পে খরচের হিসাব পর্যালোচনায় পরিকল্পনা কমিশন বলছে, মোটরসাইকেল-১০টি, আসবাবপত্র-৬০টি, কম্পিউটার-২৪টি এবং অনাবাসিক ভবন-১৩টি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মোট ২ কোটি ২১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এটাকে যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। প্রকল্পের আওতায় প্রাক্কলিত ব্যয়ের সারসংক্ষেপে প্রভাব মূল্যায়ন অংশটিতে ১টি প্রভাব মূল্যায়নের উল্লেখ রয়েছে, যার ব্যয় ৩০ লাখ টাকা। আইএমইডি প্রভাব মূল্যায়নের জন্য সরকারের একটি বিশেষায়িত সংস্থা এ বিভাগ নিয়মিত বিভিন্ন প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করে থাকে বিধায় প্রকল্প হতে এ ব্যয় বাদ দিতে হবে।

সেচ উইং বলছে, প্রকল্পটি নিয়ে কয়েক দিন আগে পিইসি হয়েছে। বেশ কিছু নির্দেশনাসহ ডিপিপি সংশোধন করে আবার পাঠাতে বলা হয়েছে।