রূপের পসরা সাজিয়েছে কাশ্মিরের ডাল লেক

Printed Edition

সীমান্ত আকরাম

আমাদের প্ল্যান ছিল কাশ্মিরের প্রাণকেন্দ্র শ্রীনগরে সাইটসিয়িং করা। প্ল্যান অনুযায়ী সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি। শুরুতেই চলে যাই শ্রীনগরের বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এরপর একে একে শালিমার বাগ, নিশাত বাগ ও টিউলিপ গার্ডেন ঘুরাফেরা শেষে আমাদের এবারের গন্তব্য ডাল লেক। যাওয়ার সময় ডাল লেকের কোল ঘেঁষেই আমাদের যেতে হয়েছে। এর মধ্যেই শ্রীনগরের একটি অভিজাত হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। কাশ্মিরের রাজকীয় ভোজ ‘ওয়াজওয়ান’। এটি একটি বাহারি পদের ভোজ যা কাশ্মিরি মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বপূর্ণ রন্ধনপ্রণালীর এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এই রাজকীয় ভোজ বিশ্বজুড়ে তার অনন্য স্বাদ, সুগন্ধ ও পরিবেশনার জন্য বিখ্যাত। এটি প্রায়ই বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। ওয়াজওয়ান থালায় পরিবেশন করা হয়। এই রাজকীয় ভোজের প্রধান উপাদান গোশত, বিশেষ করে খাসির গোশত, মেষশাবক বা গরুর গোশত; সাথে কিছু নিরামিষ পদও থাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে এলাম কাশ্মিরের রূপের রানী খ্যাত দর্শনীয় স্থান ডাল লেকে।

চোখজুড়ানো এক মোহনীয় সৌন্দর্য ডাল লেক। স্মৃতিকে ফ্রেমে বাঁধাই করার মতো সৌন্দর্য। মেঘছোঁয়া পাহাড় থেকে যেন এই লেক বেরিয়ে এসেছে। সন্ধ্যায় যখন দক্ষিণ পশ্চিমের আকাশে পাহাড়ের মাথায় কাস্তের মতো চাঁদ উঠতে থাকে, তখনই বোঝা যায় এই লেকের সৌন্দর্য নান্দনিকতায় ভরপুর। রূপের রানী এই ডাল লেক যেন রূপের পসরা সাজিয়েছে।

চাঁদের নিচের পাহাড়গুলোর নামও বেশ। স্থানীয়রা এগুলোকে চশমা শাহী ও পরীমহল নামে ডাকে। মনে হবে, সকালে রওনা করে বিকেলে পরীমহলের মগে উঠতে পারলে চাঁদটাকে ধরা যেত। লেকের পাশের মূল সড়কের ধার ধরে ঘাট রয়েছে এক থেকে ১৫টি। এখানে তাজ থেকে শুরু করে দুনিয়ার সব তারকা হোটেল রয়েছে। মিশন কাশ্মির ছবির জন্য এই লেক খ্যাত। পুরো পদ্মা ফুলে ভেসে থাকা এই লেকের পূর্বাংশ দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ছুটে আসেন। লেকের উত্তর দিকে হাউজবোটগুলোর অবস্থান। একটির গায়ে আরেকটি লেগে আছে। যারা নৌকা থেকে এই লেক আর পাহাড়কে উপভোগ করতে চান, তারা এসব হাউজবোটে রাত্রিযাপন করেন। কাশ্মিরের ডাল লেকের একটি প্রধান আকর্ষণ হলো হাউজবোট। পানির উপর ভাসমান বাড়ি। ডাল লেকে প্রায় হাজারের মতো হাউজবোট রয়েছে। ভেতরে অত্যাধুনিক হোটেলের মতো নানান ব্যবস্থাপনা রয়েছে। শোবার ঘর, বসার ঘর, বাথরুম সবই আছে। সব কিছুই সুসজ্জিত। সুন্দর কার্পেট বিছানো, পর্দা টানানো। আরো আছে বারান্দা, যেখানে বসে অনায়াসে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। হাউজবোটের ভেতরে কাঠের জাফরি কাটা দেয়ালগুলো অনিন্দ্য সুন্দর। মোট কথা, এই হাউজবোটে পাওয়া যাবে সব ধরনের ব্যবস্থা যা একজন পর্যটকের একান্ত প্রয়োজন।

কাশ্মিরের মুকুটের রতœ বলা হয় নগরবেষ্টিত এই হ্রদকে। স্থানীয়রা একে বলে ডাল ঝিল। শীতে বরফে ঢাকা পড়ে যায়। ২০ মিটার গভীর পুরো লেক বরফ হয়ে যায়। এর ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ায় মানুষ। শহরের অন্যতম ব্যবসায়িক স্থানও এই লেক। মাছ ধরা এবং জলজ ফুলের প্রধান উৎস এই লেক। প্রায় ১৮ বর্গকিলোমিটারের এই লেকে গুল্ম, লতা আর জলজ ফুলে ভরা। স্বচ্ছ পানির নিচে সবুজ গুল্মগুলো যেন নড়েচড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাইলে পানির ঠাণ্ডা টের পাওয়া যায়।

এখানে মাঝারি ধরনের খাটিয়া আর কাপড়ের টুল বসানো নৌকাকে শিখারা বলে। ডাল লেকের পানিতে ভেসে বেড়ানো বিশেষ ধরনের ছোট ছোট নৌকাই হলো এই শিকারা। হাজার হাজার শিকারা প্রতিনিয়ত লেকে চলাচল করছে বিভিন্ন প্রয়োজনে। কখনো পর্যটকদের নিয়ে প্রদক্ষিণ করতে, কখনো বা ব্যক্তিগত কাজে শিকারা ব্যবহৃত হয়। আমরা বিকেল নাগাদ আটজনে দু’টি শিকারা ঘণ্টাখানেকের জন্য ভাড়া করে ভেসে বেড়াই। মাঝে মধ্যে আমি আর ফাহিম বৈঠা হাতে নিয়ে শিকারা বাইতে লাগলাম। শুরুতে ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পারলেও পরে কিন্তু ঠিকভাবেই বাইতে পেরেছি। সাথে শারমিন আন্টি আর মাসুম ভাই ছিল আমাদের শিকারায়। আরেকটি শিকারায় ছিল এমরান ভাই, জুয়েল, রাফসান ও বাপ্পি। শিকারা রাইডে সবাই যেন আনন্দে মাতোয়ারা।

ডাল লেকে শীতল পানিতে বৈঠা হাতে শিকারা রাইড যেন আনন্দের মাদকতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। পানিতে যে শব্দ হচ্ছে তা যেন নীরবতার দরজার কড়া খুলে দেয়ার শব্দ। লেকের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি ভাসমান বাজার। এই বাজারে সবজি বিক্রয় করা হয়। লেকের আশপাশের এলাকার জমির সবজিই এখানে আসে। এখানে নৌকায় করে দোকান থেকে দোকানে ঘুরতে হয়। হাউজবোট থেকে মূল সড়ক বা দোকানে যেতে হলে নৌকাই ভরসা। নৌকায় ভেসে ভেসে বাহারি ফল আর নানা রকম প্রসাধনী বিক্রি করতে দেখা যায়। এটিকে কাশ্মিরের ভেনিস বললে ভুল হবে না।

হ্রদটি শঙ্করাচার্য পাহাড়ের পাদদেশে জাবারওয়ান পর্বত উপত্যকায় ৩১৬ বর্গকিলোমিটারজুড়ে একটি জলাভূমির মধ্যে অবস্থিত যা এটিকে তিন দিকে ঘিরে রয়েছে। শ্রীনগর শহরের পূর্ব ও উত্তরে অবস্থিত হ্রদটি ১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। যদিও পদ্ম ফুলের ভাসমান বাগানসহ এটি ২১ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। জম্মু ও কাশ্মির লেক কনজারভেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটি (এলসিএমএ) আগাছা অপসারণের জন্য দুই ডজনেরও বেশি মেশিন চালু করেছে এই লেকে। একেক দিক দিয়ে ডাল লেকের প্রকৃতি এবং জীবন বৈচিত্র্য একেক রকম। লেককে ঘিরে কাশ্মিরের হাজারো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ হাউজবোটের মালিক, কেউ ডাল লেকের বিশেষ নৌকা শিকারাতে পর্যটকদের নিয়ে পরিভ্রমণ করে, আবার কেউবা লেক বাজারে সবজি বিক্রি করে।

ডাল লেকের উত্তর-পূর্ব দিকে শালিমার বাগ ও নিশাত বাগ এই দু’টি বাগান অবস্থিত। গাছপালায় ভরপুর বাহারি ফুলের সমারোহে সজ্জিত বাগান দু’টি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। শালিমার বাগ ও নিশাত বাগের পাশেই অবস্থিত এশিয়ার বৃহত্তম টিউলিপ গার্ডেন। এখানে প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে টিউলিপ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

কাশ্মির ভ্রমণে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ডাল লেক ঘিরে। রাতের ডাল লেক আরো মোহনীয় ও নান্দনিক। স্বচ্ছ পানিতে আলোর ঝলকানি মনে হবে সোনা ঝরছে। ডাল লেককে কেন্দ্র করেই আশপাশে গড়ে ওঠেছে শ্রীনগরের আবাসিক হোটেলগুলো। পর্যটকরা এখানেই রাত্রিযাপন করেন। এই শ্রীনগরই কাশ্মিরের কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকেই কাশ্মিরের অন্য সব দর্শনীয় স্থানে যাওয়া-আসা করতে হয়। ডাল লেকের সৌন্দর্য ভোলার মতো নয়। অমলিন স্মৃতি হয়ে থাকবে।