গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বাংলাদেশ

Printed Edition

আমরা আগামীর একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ, নিরাপদ বাংলাদেশ চাই, যেখানে সরকারের সাথে ভিন্ন মতের কারণে, গঠনমূলক সমালোচনার কারণে গুম, হত্যার ভয় আর থাকবে না, কোনো শাসক আর কোনো আয়নাঘর তৈরির দুঃসাহস দেখাবে না। আইন তৈরি, পরিবর্তন, পরিমার্জন হবে জনগণের স্বার্থে, প্রয়োগও হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। বৃহৎ স্বার্থে সরকার কঠোর থেকে কঠোরতর হবে জনগণের জন্য কাজ করবে, নিজ স্বার্থে নয়

‘গুম’ দুই অক্ষরের এই ছোট্ট শব্দটির ভয়াবহতা কতটা তীব্র তা বাংলাদেশের বিগত কয়েক দশকের রাজনীতির নামে অপরাজনীতির দিকে তাকালেই খুব ভালোভাবে অবলোকন করা যায়। এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে বহু আলোচনা হলেও সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে চোখ আটকে গেল : ‘গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না, যদি বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ বাতিল না হয়।’ যেহেতু সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন প্রেষণে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আমার, তারই পরিপ্রেক্ষিতে মনে হলো এ বিষয়ে নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু লেখা যাক। তবে তার আগে দেখা যাক, অন্যান্য দেশ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের আইন কিভাবে ব্যবহার করে।

যুক্তরাষ্ট্র : নাইন-ইলেভেনে হামলার পর ‘প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট’ চালু করা হয়, যার আওতায় সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের বিচার ছাড়াই আটক রাখার সুযোগ দেয়া হয়। গুয়ান্তানামো বে কারাগারে বছরের পর বছর ধরে অনেককে আটক রাখা হয়েছে।

ভারত : ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ (ঘঝঅ) সরকারকে কোনো ব্যক্তিকে ১২ মাস পর্যন্ত বিনাবিচারে আটক রাখার ক্ষমতা দেয়। রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল সময়ে এই আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

পাকিস্তান : ‘এন্টি-টেররিজম অ্যাক্ট’ (অঞঅ) সন্ত্রাসীদের দমনের নামে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের দমন-পীড়নের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

বাংলাদেশেও ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করা হয় রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাস্তবে এটি কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে?

বিশেষ ক্ষমতা আইনের বাস্তব চিত্র

গত ৪ মার্চ ২৫, গুম-সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির কার্যক্রম নিয়ে ব্রিফিংয়ে গুম-সংক্রান্ত কমিশনে এ পর্যন্ত এক হাজার ৭৫২টি অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশন সভাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। গুমের শিকার ৩৩০ জনের অবস্থান অনুসন্ধানের চেষ্টা চলছে বলেও জানান কমিশন সভাপতি। এমন কি এসব গুমের সাথে প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরও যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে ওই কমিশন।

গুম কমিশনের সভাপতি আরো বলেন, ‘গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হবে এবং কালিমা মোচন হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ রয়েছে, তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কমিশন অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এই তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই কমিশনের মূল লক্ষ্য। একজন সাবেক সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে গুম কমিশনের সভাপতির ওই বক্তব্যকে সম্মান জানাচ্ছি। ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ প্রণয়ন করা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। উদ্দেশ্য ছিল, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিহত করা।

আমি যে সময়ে গোয়েন্দা সংস্থায় ছিলাম সেই সময়ে ওই আইন প্রয়োগ-বিষয়ক আমার যে অভিজ্ঞতা পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে তুলে ধরছি। দেশের কোথাও কোনো বহিরাগত ও অভ্যন্তরীণ সহযোগী মাফিয়াচক্র সার্বভৌমত্ব বা ওই রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যক্রম করছে কি না অথবা কোনো পরিকল্পনা করছে কি না সে বিষয়ে নজরদারি এবং তথ্য সরবরাহ করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। তারই ভিত্তিতে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তথ্যের আলোকে এসব চক্রের সদস্যদেরকে আটক করা হয়, প্রতি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয় যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, সচিব, গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থাকেন। ওই মিটিংয়ে আটককৃত ব্যক্তিদের অপরাধের সত্য-মিথ্যা পরিমাণ যাচাই করে গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রিপোর্ট করেন এবং তার ভিত্তিতে কাকে কতদিন তার অপরাধের ভিত্তিতে আটক রাখা হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিরপরাধ ব্যক্তিদের অতি দ্রুত ছেড়ে দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সবসময় চাপে রাখতো। স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই অনুসারে কাজ করে। সে ক্ষেত্রে এখানে গোয়েন্দা বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি যত দিন প্রেষণে গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলাম জোর দিয়ে বলতে পারি, তৎকালীন সময়ে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা নিতে এই আইন ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু দুঃখের বিষয় পরবর্তীতে দেখা যায় এটি জনস্বার্থে তথা রাষ্ট্রের উন্নয়নে ব্যবহার না করে; বরং ক্ষমতাসীন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা বিভাগ এবং অন্যান্য সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যকে লোভ দেখিয়ে এই আইনের ব্যাপক অপব্যবহার করা হয়েছে। যার দৃষ্টান্ত আমরা গত ১৫ বছরেও দেখেছি।

বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপব্যবহার

বিগত ১৫ বছরে বিশেষ ক্ষমতা আইন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের নিয়ন্ত্রণে এনে এই আইন প্রয়োগ করেছে বিরোধী দল দমন করতে। এক সময় আইনটি দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হলেও, পরে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অস্ত্র হয়ে ওঠে। সশস্ত্রবাহিনী জনগণের নিরাপত্তার জন্য গঠিত হলেও কিছু সুবিধাবাদী কর্মকর্তা রাজনৈতিক দলের অনুগত হয়ে এই আইনের অপব্যবহার করেন।

র‌্যাব ও বিশেষ ক্ষমতা আইন

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গঠনের শুরুতে দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছিল। অপরাধীদের দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল, যা জনগণের সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল, এই বাহিনী রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের টার্গেট করে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। সশস্ত্রবাহিনীর কতিপয় সুবিধাবাদী গোলাম দ্বারা এই আইনের মাধ্যমে কেবল বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি ভিন্নমত পোষণ করা ব্যক্তিদের উপর নিপীড়ন চালানো হয়েছে। অতীতের শাসনব্যবস্থায় এসব কতিপয় দাস পুলিশের পাশাপাশি সামরিক কর্মীদের দ্বারা দেশকে দাস রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য একটি ভিন্ন দেশের পরামর্শে এর ব্যাপক অপব্যবহার করা হয়। তাই পুনরায় দাসত্বের শৃঙ্খলে সশস্ত্রবাহিনীকে আবদ্ধ করা, আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর মর্যাদা পুনরায় ক্ষুণ্ণ করা কারো জন্যেই কাম্য নয়।

রাজনৈতিক সঙ্কট ও কর্তৃত্ববাদী শাসন

আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের বড় সমস্যা হলো, তারা ক্ষমতায় আসার আগে গণতন্ত্রের কথা বললেও ক্ষমতায় গিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে এবং বিরোধী মত দমন করে। এ জন্য সিস্টেম যেমন পরিবর্তন করতে হবে, পাশাপাশি রাজনীতিবিদদেরও এগিয়ে আসতে হবে, নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে তবে তা ক্ষমতা লাভ করে কর্তৃত্ববাদী শাসন বাস্তবায়নের জন্য নয়, অন্য কোনো রাষ্ট্রের তাঁবেদারি করার জন্য নয়; বরং নিজ দেশের জনগণের জন্য, দেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য, উন্নয়নের জন্য একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে হবে। যেমনটি আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি আমাদের প্রতিবেশী দেশে। স্বৈরাচারী সরকার দেশ থেকে পালিয়ে তাদের দেশে অবস্থান নেয়ার পর থেকে তাদের দেশের সরকারি দল এবং বিরোধী দল নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ দূরে সরিয়ে রেখে জাতীয় স্বার্থে একসাথে কাজ করছে আমাদের দেশের অবস্থান বোঝার জন্য।

বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম সমাধান

বাংলাদেশে বিশেষ ক্ষমতা আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে, এর অপব্যবহার রোধ করতে হবে। সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা। বিরোধী দলের প্রতিনিধি থাকলে, সরকার শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্য আইনটি ব্যবহার করতে পারবে না। বিরোধী দলের উপস্থিতি নিশ্চিত করবে যে, আইনের প্রয়োগ হবে শুধু রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য নয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করবে।

উপসংহার : আমরা আগামীর একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ, নিরাপদ বাংলাদেশ চাই, যেখানে সরকারের সাথে ভিন্ন মতের কারণে, গঠনমূলক সমালোচনার কারণে গুম, হত্যার ভয় আর থাকবে না, কোনো শাসক আর কোনো আয়নাঘর তৈরির দুঃসাহস দেখাবে না। আইন তৈরি, পরিবর্তন, পরিমার্জন হবে জনগণের স্বার্থে, প্রয়োগও হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। বৃহৎ স্বার্থে সরকার কঠোর থেকে কঠোরতর হবে জনগণের জন্য কাজ করবে, নিজ স্বার্থে নয়।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি