নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন,
‘ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবেই। এটা ঐকমত্য কমিশনের সনদেরই অংশ- এর সাথে নির্বাচন সরাসরি জড়িত। আমরা যে ঘোষণা দিয়েছি, তা রক্ষা করতে হবে। এটা কথার কথা নয়, উৎসবমুখর নির্বাচনই হবে।’
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বুধবার সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ‘অতি জরুরি বৈঠকে’ সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
সনদই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরবর্তী অধ্যায় : অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, জুলাই সনদ সেই বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়। আমরা যে সংস্কারের কথা মুখে বলে যাচ্ছিলাম, রাজনৈতিক দলগুলো প্রকৃত অর্থেই সেই সংস্কারকে বাস্তবায়নযোগ্য করে তুলেছে। তাই জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সারা জাতির জন্য হবে এক উৎসব।’
তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা যেমন সবাই মিলে সনদ তৈরি করেছেন, আমাদের সরকারের দায়িত্ব হলো সবাই মিলে উৎসবমুখর নির্বাচনটি করে দেয়া। তা হলেই আমাদের কাজ পূর্ণতা পাবে।’
অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আপনারা : রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে আপনারা যে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, তা ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আপনারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন- এটা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ তিনি জানান, জুলাই সনদে স্বাক্ষরের সময় যে কলম ব্যবহার করা হবে, তা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। ‘এটা এমন এক ঘটনা, যার ভেতরে থেকে আমরা এর বিশালত্ব পুরোপুরি অনুভব করতে পারছি না,’- বলেন ইউনূস।
জুলাই সনদ জাতির জন্য এক মহাসম্পদ : অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘জুলাই সনদ জাতির জন্য এক মস্ত বড় সম্পদ হয়ে থাকবে। মাসের পর মাস বৈঠক, হতাশা ও আশার দোলাচল শেষে আমরা সফল হয়েছি- এটি অসমাপ্ত থাকেনি।’ তিনি জানান, সনদের দলিলগুলো শুধু সরকার বা কমিশনের নথিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না- ‘এসব দলিল সহজ ভাষায় জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে কেন আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি।’
সরকার হিসেবে এই সনদ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও সরকারের বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিতর্কগুলোই আমাদের সম্পদ : প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সনদ প্রণয়নের সময় যে বিতর্কগুলো হয়েছে, সেগুলোই আমাদের রাজনৈতিক চর্চার অংশ। এসব আলোচনা ভিডিও আকারে সংরক্ষণ ও বই আকারে প্রকাশ করা হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে- কেমন একটি জাতি গড়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে এই ঐকমত্য গঠিত হয়েছিল।’
সনদ ও নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক : অধ্যাপক ইউনূস স্পষ্ট করে বলেন, সনদ ও নির্বাচন দুটি আলাদা বিষয় নয়। ‘উত্তরণ কীভাবে হবে, সেই প্রশ্নের উত্তরও জুলাই সনদে দেয়া আছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেভাবেই রূপান্তরটি ঘটবে। আমাদের দায়িত্ব হলো- আপনারা যত কষ্ট করে যেটি রচনা করেছেন, আমরা যেন সেটিকে বাস্তবে রূপ দিতে পারি নির্বাচনের মাধ্যমে।’ তিনি আরো যোগ করেন, ‘আগামী শুক্রবার আমরা এই আশাকে সারা জাতির সামনে আনবো উৎসবমুখরভাবে, ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।’
১৭ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান : প্রধান উপদেষ্টা জানান, ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদে আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হবে।
‘আমরা উৎসবমুখরভাবে সেখানে যাব, দলিলে সই করব, আর সারা জাতি সেই উৎসবে শরিক হবে। আপনারা সামনের সারির মানুষ হিসেবে স্বাক্ষর করছেন, কিন্তু দেশের প্রতিটি মানুষ চিন্তা ও অনুভবের মাধ্যমে আপনাদের সাথে সই করছে,’ - বলেন ড. ইউনূস। তিনি বিশ্বাস প্রকাশ করেন, এই সনদ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় এক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে, যা ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকনির্দেশ নির্ধারণ করবে।
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিকেলের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, সদস্য বিচারপতি মো: এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো: আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। পাশাপাশি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়াও বৈঠকে অংশ নেন।
প্রধান উপদেষ্টার আশার বাণীতেও অনৈক্যের সুর দলগুলোতে : বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষর হবে শুক্রবার। এ নিয়ে গতকাল বুধবার সনদ ইস্যু নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ‘অতি জরুরি’ বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সন্ধ্যা ৬টার পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদ ও আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে আশার কথা শোনালেও রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, সিপিবি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
সভার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, আমরা শুক্রবার দিন জুলাই জাতীয় সনদের স্বাক্ষর করতে পারব বলে আশা করছি। সে জন্য দ্রুততার সাথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছি। দলগুলোও তাদের প্রতিনিধির নাম দিয়েছে। সে জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমরা এমন ব্যবস্থা করব যাতে স্বল্প সময়ে প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করতে পারেন। স্বাক্ষরের জন্য অঙ্গীকারনামার পাতাটি রাখব। পরে সেটি মূল সনদে সন্নিবেশিত করা হবে। তবে সনদ নিয়ে তথ্য এদিক সেদিক হয়েছে। আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। আমরা আনন্দঘন পরিবেশের মাধ্যমে সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানটি করব। গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর যেসব সংস্কার কমিশন হয়েছিল সেগুলোর সুপরিশেরর প্রেক্ষিতে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করতে পেরেছি। তবে কিছু কিছু বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। সেগুলো সনদে উল্লেখ থাকবে। যাতে দলগুলো কী কারণে ঐকমত্য হয়েছিল এবং কী কারণে ঐকমত্য হয়নি সেগুলো লেখা থাকবে। সনদ প্রত্যেকটি নাগরিকের কাছে যাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় এ জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে। দলগুলো কমিশনকে সহায়তা অব্যাহত রেখেছে এ জন্য ধন্যবাদ। যে পরিবর্তনের ধারা তৈরি হয়েছে সেটি অব্যাহত থাকবে এটিই প্রত্যাশা।
বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই জাতির সামনে। আমাদেরকে এমন পরিবেশ বজায় রাখতে হবে যাতে ফ্যাসিবাদ আর জায়গা না পায়। নির্বাচন বিলম্বিত হলে সঙ্কট বিস্তৃত হবে। জুলাই সনদ প্রায় প্রণয়ন হয়েছে। কিছু নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। সে জন্য তো প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোর সাথে আলোচনা করেছেন। যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে সবাই একমত হতো তাহলে তো এত সময় লাগতো না। আমাদেরকে দেশের দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারের প্রতি সমর্থন আমাদের ছিল। তবে সেটি অনন্তকালের জন্য নয়। সচিবালয়ে বদলি ও নিয়োগে যে কমিটি করা হয়েছে সেটিতে আমরা চরম অসন্তোষ প্রকাশ করছি। সেখানে একধরনের রাজত্ব তৈরি হয়েছে। আমরা চাই প্রতিরক্ষাবাহিনীগুলোর মধ্যে ভারসাম্য ও সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। এই মুহূর্তে অতি বিপ্লবী হওয়ার দরকার নেই। আমরা এফর্ট করতে পারব না।
তিনি বলেন, সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি নির্বাচিত সরকার দরকার। এখনো নির্বাচনের চার মাস বাকি। আমরা তো বলেছি যে, উচ্চ কক্ষ চাই। কিছু ছোটখাটো বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। সে জন্য এসব বিষয়ে গণভোটের প্রশ্ন যুক্ত করা হলে তো সেটি ব্যালট থাকল না। নির্বাচনের দিনই গণেভোট হলে আলাদা আয়োজন ও প্রস্তুতির দরকার নেই। আমরা মনে করি, যারা নির্বাচনের আগেই গণভোটের কথা বলছে সেটি তাদের অধিকার। তবে আমাদের কাছে মনে হয়- সেটি নির্বাচন বিলম্বের অভিপ্রায়। কারণ গণভোট তো জুলাই সনদের অংশ নয়। সে জন্য ঐকমত্য কমিশন সরকারকে সুপারিশ করবে। আমরা সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপের সময় সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদে স্বাক্ষর হলেও পরবর্তী সময়ে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদেরকেই এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি জাতীয় সংসদের ওপর নির্ভর করবে।
তিনি বলেন, আমরা জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করব, তবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ যেগুলো রয়েছে, সেগুলো অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে।
একদিনে দুই ভোট হলে গণভোটের গুরুত্বই থাকবে না : ডা: তাহের
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, গণভোট আর জাতীয় নির্বাচন আলাদা বিষয়; একদিনে করার প্রস্তাব উদ্ভট আলোচনা। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নভেম্বরে গণভোট দিতে হবে।
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনা শেষে রাতে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
ডা: তাহের বলেন, বিএনপি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে আগে দ্বিমত করলেও পরে গণভোটের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ জন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ। তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে আমরা এক জায়গায় আসছি এবং এনসিসি সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সেই সবগুলোকে একটা প্যাকেজ করে একটা প্যাকেজের উপরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এখন গণভোট কখন হবে? এই নিয়ে আবার কিছুটা আমাদের ভিতরে ডিফারেন্স। আমরা বলেছি, গণভোট হচ্ছে রিফর্মস কমিশন কমিটির জন্য। এটাকে আলাদা বিষয় আর জাতীয় নির্বাচন একটি আলাদা বিষয়।
জামায়াত নেতা বলেন, গণভোটে এমন কিছু দিক আছে যেগুলা যদি হ্যাঁ-না ভোটে না হয়, তাহলে তার ভিত্তিতে নির্বাচনের ক্যারেক্টারে কিছু পরিবর্তন হবে। যেমন আপার হাউস পিআর সিস্টেম। নির্বাচনের আগেই ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত জনগণের কাছে পৌঁছতে হবে এবং সেই সিদ্ধান্তের আলোকে জাতীয় নির্বাচনে আপার হাউজের ভোট হবে। যদি এটা নির্বাচনের দিনেই হয় কেউ কেউ চাচ্ছে, নির্বাচন একসাথে তাহলে তো আপার হাউস নির্বাচন দিন পর্যন্ত আর পাস হলো না। তিনি বলেন, একদিনে জাতীয় ও গণভোট হলে ভোট কাস্টিং একেবারেই অপ্রতুল হবে। কারণ সেদিন গণভোটের কোনো গুরুত্বই থাকবে না।
তাহের বলেন, আশা করি, ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাব এবং অনিশ্চয়তা আমরা দেখি না।
জামায়াতে ইসলামীর শূরা সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আলোচনার পর কিছু বিষয় ছাড়া অনেকগুলো বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে দেশে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো নিয়েই জুলাই সনদ স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে আমরা নভেম্বরের মধ্যে গণভোট ও সনদের আইনীভিত্তি দেয়ার দাবি জানাই।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, আমরা দীর্ঘ সময় ধরে জুলাই সনদ প্রণয়নের দিকে অগ্রসর হয়েছি। শেষ মুহূর্তে কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। কেননা সনদের খসড়ায় নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো বাস্তবায়নের স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। অঙ্গীকারনামায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়নি। গণভোটের প্রশ্ন কী হবে সেটি দিনক্ষণ পরিষ্কার নয়। আমরা চাই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথটা পরিষ্কার করে তারপর সনদ স্বাক্ষর করার দিকে অগ্রসর হবো। তবেই জাতির প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন হয়েছে। আমি মনে করি জুলাই সনদের কাজটি প্রায় শেষ এখন আমরা সনদে স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। ঐকমত্য কমিশন যেভাবে জটিল কাজটি সমাধানের পথে এগিয়েছে তা নজিরবিহীন।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই পর্যন্ত এসেছি। আমাদের প্রচেষ্টাগুলো যাতে ব্যর্থ না হয়। অনেকের অনেক বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট বা দ্বিমত রয়েছে। আমরা সেগুলো নিরসনের চেষ্টা করব। জাতি শঙ্কিত হয় এমন কিছু যাতে আমরা না করি। জুলাই সনদ যাতে আগামী দিনের পথনির্দেশ হয়। প্রধান উপদেষ্টা তার দৃঢ় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে এই প্রত্যাশা করছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, আমরা বৃহত্তর ঐক্যের জায়গায় এসেছি। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো সরকার সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করবে। বিশেষ করে গণভোটের সময় ঠিক করবে। আমরা একটি ডিসেন্ট জুলাই সনদ ও নির্বাচন চাই।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে অনেকেই সন্দেহে ছিল; কিন্তু আমরা মাসের পর মাস সবার প্রচেষ্টায় একটা জায়গায় এসে আলোচনাটা প্রায় সম্পন্ন করার পর্যায়ে এসেছি। ১৭ অক্টোবর আমরা সনদের স্বাক্ষর করতে যাচ্ছি। যেসব বিষয়ে একমত হয়েছি সে বিষয়ে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদেরকে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের পরিচালনায় বৈঠকে আরো বক্তব্য দেন- খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রব, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী প্রমুখ। এ সময় কমিশনের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি নড়বড়ে হওয়ার আশঙ্কা : বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই সনদ মূলত ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক সংস্কার ও নতুন সমাজচুক্তির নির্দেশনামূলক দলিল। এতে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন, দলীয় অর্থায়নের স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রধান দলগুলো যদি এতে স্বাক্ষর না করে, তা হলে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের’ প্রস্তাবিত সংস্কারের বৈধতা ও নৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।
নির্বাচনী বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে : সনদে স্বাক্ষর না করা দলগুলো যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তবে তারা নীতিগতভাবে বিদ্যমান সংস্কার কাঠামোর বাইরে অবস্থান করবে। এতে ভোটারদের মধ্যে বিভাজন এবং আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।
অপর দিকে, তারা যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের আশঙ্কা তৈরি হবে- যা গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়াকে স্থবির করে দিতে পারে।
নীতিনির্ধারণ ও সংস্কার বাস্তবায়নে জটিলতা : জুলাই সনদে শিক্ষা, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে নির্দিষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা রয়েছে। দলীয় ঐকমত্য ছাড়া এসব নীতির বাস্তবায়ন হবে অসম্পূর্ণ এবং স্বল্পস্থায়ী। বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সংস্কারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হলে সনদে সব দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য : রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করা মানে হলো দলগুলো নিজেদের সংস্কার-অঙ্গীকার থেকে পিছিয়ে যাওয়া।’
তারা বলেন, এ সনদে ঐকমত্যই হতে পারে ‘নতুন প্রজাতন্ত্র’ গঠনের ভিত্তি এবং ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামোর নৈতিক ভিত্তি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি শেষ পর্যন্ত পূর্ণ ঐকমত্য না গড়ে ওঠে, তা হলে তা কেবল নির্বাচনী বৈধতাকেই নয়, বরং গোটা জাতীয় রূপান্তর প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। জুলাই সনদ তাই শুধু একটি দলিল নয়, বরং জাতীয় ঐক্য ও পুনর্জাগরণের প্রতীক- যার বাস্তবায়নেই নির্ভর করছে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক যাত্রার দিকনির্দেশ।



